রোজার শুরুতেই অস্থির হয়ে উঠেছে লেুবর বাজার। দেশে সবচেয়ে বেশি লেবু উৎপাদন হয় মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায়। এই দুই উপজেলায় রয়েছে শতাধিক লেবুর আড়ত। এলাকায় প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার লেবু পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। রমজানে বাজারে লেবুর চাহিদা বেশি থাকায় ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সপ্তাহখানেক ধরে বাজারে লেবুর দাম আকাশছোঁয়া। হালি প্রতি প্রকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬০-২২০ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে হালি ৪০-১৬০ টাকা থাকলেও খুচরা বাজারে তা ৬০-২২০ টাকা ছুঁয়েছে। বাজারে পর্যপ্ত লেবু থাকার পরও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের কাঁচাবাজারের কয়েকটি আড়তের দোকান ঘুরে এ চিত্র পাওয়া যায়। আড়তদাররা বলেন, গত ৯ মাস লেবুর তেমন চাহিদা ছিল না। কৃষকদের খেতের মধ্যেই লেবু পড়ে ছিল। শ্রমিকদের টাকা দেওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়েছে। ১-২ মাস লেবুর চাহিদা থাকে তখন দামও একটু থাকে। তাছাড়া রমজান মাস থাকার কারণে লেবুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বেড়েছে। অথচ এ লেবুর হালি কিছুদিন আগেও বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকায়।
সরেজমিন কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজার, আদমপুর বাজার ও শমসেরনগর বাজার ও শ্রীমঙ্গলের পুরান ও নতুন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৬০ টাকা। হালি বিক্রি হচ্ছে ৬০-২২০ টাকায়। তবে ছোট লেবুর দাম কিছুটা কম।
বাজারে লেবু কিনতে আসা পারভেজ আহমদ জানান, ‘আমার পরিবারের সবসময় লেবুর দরকার হয়। তাছাড়া রমজান মাস। ইফতারের সময় লেবুর শরবত করে আমরা সবাই খাই। এখন ভানুগাছ বাজারে আসলাম লেবু নেওয়ার জন্য। কিন্তু যে লেবু নিয়েছিলাম ১ সপ্তাহে আগে ১৫-২০ টাকা হালি। এখন সেই লেবু কিনতে বাজারে এসে দেখি ১২০-২২০ টাকা। অবাক লাগে কী করে এমন দাম হঠাৎ করে বাড়ল। কিন্তু আমার লেবুর প্রয়োজন থাকায় লেবু এত দামে নিতে বাধ্য হচ্ছি।’
শ্রীমঙ্গলের মা বাণিজ্যালয়ের আড়তদার রাজিব আহমদ জানান, ‘লেবু তিন ধরনের রয়েছে। বড়, ছোট ও মাঝারি। আমরা প্রতিটা লেবু ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা করে পাইকারী বিক্রি করছি। কিছুদিন ধরেই লেবুর বাজার চড়া। যার কারন হলো, ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকে না। এই ২-১ মাস লেবুর চাহিদা থাকে। যার কারণে লেবুর এই দাম। এবার লেবুর ফলন ভালো হলেও সঠিক সময়ে কৃষক লাভ করতে পারেনি। ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকেনা। ফলে কৃষকরা ক্ষতির মধ্যে থাকে। এখন সরবরাহও কম। তাই দাম চড়া। এখানে বিক্রেতাদের কিছু করার নেই। চাহিদা আর সরবরাহের কথা বিবেচনায় দামের এই চড়া ভাব আরো বেশ কিছুদিন থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লেবু দাম দিয়ে রাখি। কিছু টাকা হাতে রেখে বিক্রি করে ফেলি। কিন্তু প্রশাসন আমাদের মাঝে মাঝে এসে জরিমানা করেন। এতে যেমন আমাদের ক্ষতি হয় তেমন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতেও মন চায়।’
কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ বাজারের লেবু বিক্রেতা হাসিম আলী বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজার থেকে হালি ৮০-১২০ টাকায় কিনে আনি। অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্রিও কমেছে সমান হারে। এদিকে রমজানের জন্য লেবুর শরবতে উপকারিতা থাকায় লেবুর চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাজারে লেবুর দাম বেড়েছে।’
এদিকে শ্রীমঙ্গলের লেবুর আড়তদার আবু তাহের বলেন, শ্রীমঙ্গলের পাইকারি বাজারে যে পরিমাণ লেবু আসে, সে পরিমাণ লেবু দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটানোই অসম্ভব। তার ওপর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লেবু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। ফলে স্থানীয় বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান কম থাকায় দাম বাড়ছে। আজ পাইকারি আড়তগুলোতে গড়ে বড় সাইজের প্রতি পিছ লেবু ৪০ টাকা, মাঝারি সাইজের প্রতি পিছ লেবু ২৫ টাকা এবং ছোট সাইজের প্রতি পিছ লেবু ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
স্থানীয় লেবু বাগানের মালিক সেলিম আহমেদ বলেন, ‘এখন লেবুর মৌসুম না থাকায় লেবুর দাম বাড়তি। রমজানের আগে প্রতি গাড়ি লেবু (৩০০ পিচ) ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। এ দামে লেবু বিক্রি করে উৎপাদন খরচ, শ্রমিক খরচ উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় গাড়ি ভাড়া ভর্তুকি দিতে হয়।’
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলার এ বছর ১২০০ হেক্টর জমিতে লেবুর আবাদ হয়েছে। এখন লেবুর মৌসুমও নয়, আর রমজান মাসে শরবতের জন্য লেবুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লেবু দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। লেবুর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনেও এটিও একটি কারণ।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইসলাম উদ্দিন ও কমলগঞ্জ উপজেলা নিবার্হী অফিসার মাখন চন্দ্র সুত্রধর বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিদিন বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। অভিযানে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত জরিমানা করা হচ্ছে, সতর্ক করা হচ্ছে। কোনো ব্যবসায়ী যদি সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করেন আমরা অভিযোগ পাই, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসএস/এসআর