দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় রাজশাহীতে আলু বেশি চাষ করা হয়। করোনার পর থেকে ভালো দাম পাওয়ায় আলুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন চাষিরা। এ কারণে চলতি মৌসুমে লোন করে হলেও আলু চাষে মেতে উঠেন তারা। কিন্তু এবার আলুর ফলন ভালো হলেও দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা।
বর্তমানে বাজারে আলু যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচ উঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার আলু সংরক্ষণে হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে বাড়তি চাপের মুখে পড়েছেন আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ কারণে কৃষকের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে তাদের উৎপাদিত আলু।
এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৪ থেকে ১৬ টাকা হলেও জমি থেকে তা ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা সাধারণত লোকসান থেকে বাঁচতে উৎপাদন মৌসুমে আলু না বেচে হিমাগারে রাখেন। কিন্তু এবার সেখানেও বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার কেজিতে ২ টাকা বাড়িয়ে হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হয়েছে। এতে কৃষককে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বাড়তি গুনতে হবে। হিমাগার, কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কৃষকরা জানান, হিমাগার মালিকরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ভাড়া বাড়াচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছেন। কৃষকরা এর প্রতিবাদ করলেও কাজ হচ্ছে না। কৃষকরা যখন আলু বিক্রি করে তখন দাম থাকে না। কিন্তু যখন দাম বাড়ে, তখন কৃষকদের আলু চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। হিমাগারের এমন ভাড়া বৃদ্ধি কৃষকের পক্ষে আলু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারে। তাতে একদিকে যেমন মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে সংকটও কমে আসবে।
রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের নুড়িয়াক্ষেত্র গ্রামের আলুচাষি শেখ মোবারক হোসেন জানান, ১৫ বছর ধরে তিনি বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ করছেন। এবারও ৬৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন। এবার প্রতি বিঘায় ফলন হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ মণ। বর্তমান বাজারমূল্য ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি হিসেবে এ পরিমাণ আলুর দাম ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। মোবারক হোসেন আরও জানান, প্রতি বিঘাতে আলু উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বর্তমান বাজারদরে আলু বেচে উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা।
হিমাগার সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে চালু রয়েছে ৩৫০টি হিমাগার। ওসব হিমাগারে ৩০ লাখ টন (৩০০ কোটি কেজি) আলুর ধারণক্ষমতা রয়েছে। তাতে ৮ টাকা কেজি ভাড়া হলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মোট ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু রাখতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তাছাড়া হিমাগার মালিকরা একতরফা ভাড়া বাড়ানো নিয়েও তাদের আপত্তি রয়েছে। দেশে বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ৫৫টি হিমাগার রয়েছে। সেগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আলু সংরক্ষণ শুরু হয়েছে। মৌসুমে ১০-১২ দিনেই আলুতে ভরে যায় একটি হিমাগার। এতো অল্প সময়ে ২ লাখ টন আলু মেপে হিমাগারে রাখা সম্ভব নয়। পরে হিমাগার থেকে আলু বের হতে সময় লেগে যায় ছয় থেকে আট মাস। এতে বিদ্যুৎ খরচসহ অন্যান্য অনেক খরচ বেড়ে যায়। সেজন্য এবার হিমাগারের ভাড়া আলু বের করার সময় নেওয়া হবে। অথচ গত বছরও আলু রাখার সময় ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
হিমাগার মালিকরা বলছেন, আলু রাখার ভাড়া বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন নির্ধারণ করে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে শ্রমিক, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। আর সংরক্ষণ ভাড়া বাড়ার চাপ ভোক্তা পর্যায়েও পড়বে। আমরা না বাড়ালেও সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দেবে আলুর দাম। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে জেলায় জেলায় চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, হিমাগারের বিপরীতে নেয়া ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ খরচ, লোডিং-আনলোডিং ও পাল্টানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন, বোনাস, বীমা খরচ, গ্যাস বিল, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিশেষণ করে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা। তারপরও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৮ টাকা। গত বছর ব্যাংক সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশ হয়েছে। তবে বিদ্যুতের বিল অপরিবর্তিত রয়েছে।
এদিকে কৃষকদের দাবি, আগে কেজি হিসেবে নয়, বস্তা হিসেবে হিমাগারে আলু রাখা হতো। এবার বস্তা হিসেবে রাখতে দেয়া হচ্ছে না। আগে প্রতি বস্তার ভাড়া ছিল ৩২০-৩৫০ টাকা। আর এক বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত আলু রাখা যেতো। এবার প্রতি বস্তায় ৫০ কেজির বেশি রাখা যাবে না। আর ভাড়া পড়বে ৮ টাকা হিসেবে ৪০০ টাকা।
পবা উপজেলার দুয়ারী এলাকার আলুচাষি শেখ নজরুল ইসলাম জানান, ৭০ কেজির এক বস্তা আলু হিমাগারে রাখতে গত বছর ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। কিন্তু এ বছর এই ভাড়া বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করেছে হিমাগার মালিকরা। ফলে চাষিদের আলু সংরক্ষণ খরচও বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, সব সময় বস্তাপ্রতি নয়, হিমাগারের ভাড়া কেজিতে নির্ধারিত ছিলো। সংরক্ষণশারীরা সেটা মানতেন না। তারা প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৩০ কেজি বাড়তি আলু রাখতেন। তাতে কৃষকের লাভ হলেও হিমাগার মালিকের লোকসান হতো। তবে আমরা কঠোর হয়েছি। আমরাও লোকশান দিতে রাজি নই।
এসআর