দেদারছে চলছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মেঘনা নদীতে নৌ চাদাঁবাজী। চাদাঁবাজরা নৌযান থেকে প্রকাশ্যে ও মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে এ চাঁদাবাজি করছে। যেন দেখার কেউ নেই। আড়াইহাজার উপজেলার খাগকান্দা থেকে শুরু করে বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া পর্যন্ত নৌ-যান শ্রমিকরা রনি হাসানের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চাঁদা না দিলে শুরু হয় সন্ত্রাসী দিয়ে মারধর ও পুলিশী হয়রানী। তার চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন নানা কৌশলে। এ চাঁদাবাজির টাকা নৌ ফাঁড়ি ইনচার্জ থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত ভাগ পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নৌ শ্রমিকরা রনি হাসানকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, নদীতে নির্বিঘ্নে কোন প্রকার চাঁদা ছাড়া চলাচল করতে চান।
জানা যায়, সোনারগাঁও পৌরসভার সাহাপুর এলাকার নুরা মিস্ত্রির ছেলে রনি হাসান। এক সময় সোনারগাঁওয়ের পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাকির হোসেনের পক্ষে মেঘনা নদীতে বিভিন্ন নৌযানে দৈনিক ভিত্তিতে ৩শ’ টাকার কর্মচারী হিসেবে চাঁদা আদায় করতো। পরবর্তীতে সে জাকির হোসেনকে পল্টি দিয়ে নিজের সিন্ডিকেট করে নদীতে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করেন। বর্তমানে মেঘনা নদীর ভয়ঙ্কর ত্রাস হিসেবে পরিচিত রনি হাসান। এক সময় যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, এখন সে চাঁদাবাজির টাকায় বিশাল অর্থ বৈভবের মালিক। বর্তমানে সে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা এলাকায় ৩৬ শতক জমি ক্রয় করে গড়ে তুলেন বাড়ি। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, নরসিংদী ও ভৈরব থেকে সোনারগাঁও হয়ে ঢাকা, চাঁদপুর নৌ রুটে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে রনি। এ নৌ রুটে শত শত বাল্কহেড, বার্জ, কার্গো ও ইঞ্জিন চালিত বালু, চুনা পাথর, ও কয়লাসহ বিভিন্ন মালপত্র আনা নেওয়া করে। সেসব নৌ যানকে টার্গেট করে রনি হাসান ও তার সিন্ডেকেট চাঁদাবাজি করে থাকে। প্রতিদিন এসব নৌযান থেকে ২ হাজার থেকে শুরু করে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে।
তবে সন্ত্রাসীদের মারধর থেকে রক্ষা ও নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য তাকে এ টাকা দেওয়া হয় বলে নৌ শ্রমিকরা দাবি করেছেন। এ টাকা নির্দিষ্ট স্থানে পৌছানোর পর রনির সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বিকাশে টাকা পাঠানো হয়। তবে বৈদ্যেরবাজার এলাকায় নৌ পুলিশকেও ২০০ চাঁদা দিতে হয়। রনির নাম বললে পুলিশ টাকা অর্ধেক নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেঘনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে রনি সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিকদের মারধর করে টাকা পয়সা লুটে নেয়। সেখানে পুলিশকেও নিরাপত্তা দিতে বাধা দেয়। পরবর্তীতে নৌযান মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেবে বলে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিলেই কেউ তাদের সমস্যা সৃষ্টি করে না। পুলিশ তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন। চুক্তির টাকা থেকে পুলিশও ভাগ পেয়ে থাকেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। এসব টাকা সে বসে থেকে বিকাশের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। বৈদ্যেরবাজার এলাকার তিনটি নৌ ফাঁড়ি থেকে শুরু করে তার নিজস্ব বাহিনী ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন। তাই কেউ তাকে গ্রেপ্তারে কোন ব্যবস্থা নেন না।
রনি ২০২২ সালে প্রায় ১৩ লাখ নগদ টাকা, ল্যাপটপ ও ১৩টি মোবাইল সিমসহ গ্রেপ্তার হয়। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থাকায় এক ডজন চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মামলা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার সিন্ডিকেটের এক সদস্য জানিয়েছেন, রনি মেঘনা নদীর ভয়ঙ্কর ত্রাস। তার সিন্ডিকেটে মেঘনা উপজেলার বিএনপি নেতা আব্দুল বারেকের তিন ছেলে আলী হোসেন, আবুল হাসনাত ও মহসিন জড়িত। কিছুদিন বৈদ্যেরবাজার এলাকার কয়েকজন যুবক নদীতে তাদের সঙ্গে হয়ে কাজ করলেও এখন আর করেন না বলে তার দাবি। তাদের মাধ্যমেই শ্রমিকদের মারধর করে থাকেন। মারধরের ভয়ে নৌ মালিক ও শ্রমিকরা তার সঙ্গে আঁতাত করে বিকাশে টাকা পৌছে দেন। নৌ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ফাঁড়ি পুলিশদের ম্যানেজ করেই এ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। সে ঘরে বসে মেঘনা নদীর এ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। নিরাপত্তা দেওয়ার নামে পুলিশ নদীতে টহল দেয়। পুলিশও প্রতিটি নৌ-যান থেকে চাঁদা নেন। রনির সিন্ডিকেট রাতের বেলা ডাকাতির করেন।
সরেজমিনে মেঘনা নদীর নলচর এলাকায় গিয়ে নৌ যানকে থামাতে বললেই রনি ভাইয়ের বডি বলে দাবি করেন। রনির বডি বলার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, বিকাশের মাধ্যমে প্রতিটি বডির জন্য তাকে ২ হাজার থেকে ৩৫০০ টাকা দিতে হয়। এ টাকা দিলেই নির্বিঘ্নে হামলা ও মারধর ছাড়াই তারা চলাচল করতে পারেন। তবে বৈদ্যেরবাজার নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাহবুবুর রহমান নেতৃত্বে ২টি ট্রলারকে নদীতে টহল দিতে দেখা যা। নৌ শ্রমিকদের সরল স্বীকারোক্তির প্রায় ১৭টি ভিডিও ফুটেজ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
বাল্কহেডের শ্রমিক মোস্তাকিম মিয়া জানান, মোটা বালি নিয়ে তারা চাঁদপুর যাচ্ছেন। নদীতে পুলিশ বা যে কেউ ডাকলেই রনির নাম বললে ছেড়ে দেবে। বিনিময়ে তাকে বিকাশের মাধ্যমে ২ হাজার টাকা দিতে হয়। বালি পৌছানোর পর এ টাকা দেওয়া হয়।
চুনা পাথর নিয়ে আসা কার্গো শ্রমিক আব্দুল মজিদ বলেন, রনির সঙ্গে মোবাইল ফোনে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাকে কখনো দেখেননি। তিনি রনির দেয়া বিকাশ নাম্বারে ২৮০০ টাকা পৌছে দেবেন।
অভিযুক্ত রনি হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়টি সত্য নয়। টাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলাম সত্য। তবে একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বৈদ্যেরবাজার নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. মাহবুবুর রহমান জানান, নৌ-যান শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে টহল দেওয়া হচ্ছে। তবে পুলিশের চাঁদা আদায়ের বিষয়টি সত্য নয়। বিকাশে চাঁদাবাজির বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।
নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন জানান, বিকাশের মাধ্যমে চাঁদাবাজির বিষয়টি আমার জানা নেই। পুলিশ চাঁদাবাজের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। তাছাড়া নৌ ফাঁড়ি পুলিশের বিষয়ে চাঁদা আদায়ের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআর