রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিনের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন এমদাদুল হক এমদাদ। পবা উপজেলায় তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। ক্বেউ রুদ্ধাচরণ করলেই নির্যাতন, মামলা এবং হেনস্তা ছিল এমদাদের নিত্যদিনের কর্ম। এমনকি নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তার নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি।
এমপির আশীর্বাদ এবং নিজে পবা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হওয়ার সুবাদে এমদাদ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ছেলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে বানিয়েছেন বড়গাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমদাদের বাবা মনসুর রহমান পাশের মোহনপুর উপজেলার পরিশা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। অভাবের তাড়নায় তিনি পবার মাধবপুরে বিয়ে করে ঘরজামাই থাকতে শুরু করেন। তিনি গ্রামের হাটে হাটে রবিশস্য কেনাবেচা করতেন। মনসুরের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে এমদাদ তৃতীয়। দোকানের কাজ ছেড়ে এমদাদ জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আব্দুল মজিদ সরদারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে মজিদ সরদারের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পান তিনি।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরপর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেন মজিদ সরদার। তিনি দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এমদাদকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একলাফে মজিদের আশীর্বাদে পবা উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নেন।
এরপর ২০১৪ সালে পবা-মোহনপুরে এমপি নির্বাচিত হন আয়েন উদ্দিন। এমদাদ খুব দ্রুত আয়েনের কাছের লোক হয়ে যান। ২০১৫ সালে তিনি সম্পাদক থেকে উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। এরপর তৈরি করেন নিজস্ব বাহিনী। মাত্র কয়েক বছরে পবার এক-তৃতীয়াংশ জমিতে পুকুরের খননের মাধ্যমে তিনি বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। কারণ এমদাদকে টাকা না দিলে কেউ পুকুর খনন করতে পারতেন না।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯ সালে পবার মাধাইপাড়া বিলে সাধারণ কৃষকদের ৬৫ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেন এমদাদ। জমির মালিকদের বছরপ্রতি ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার চুক্তি ছিল। কিন্তু এমদাদ কৃষকদের এক পয়সাও দেননি। উলটো বিশাল আয়তনের পুকুরটিতে নিজেই মাছ চাষ করেন।
উপজেলার মথুরা এলাকার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য জলিলুর রহমান বলেন, ৬৫ বিঘা জমির মধ্যে আমার ছিল সাত বিঘা। কিন্তু এমদাদ গত ছয় বছরেও জমির লিজের ১২ লাখ ৬০ হাজারের মধ্যে এক টাকাও দেননি। অন্য জমির মালিকরাও টাকা পাননি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে এমদাদ অন্য ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুকুরটি লিজ দিয়ে গা ঢাকা দেন। এর মাধ্যমে এমদাদ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এমদাদ বড়গাছি বাজারের সরকারি জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেন। মার্কেটের ৬৫টি দোকান স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি দোকান থেকে তিনি দুই থেকে তিন লাখ টাকা নেন। তাদের তিনি দোকান বুঝিয়ে না দিয়ে ক্ষমতার জোরে একই দোকান আবারও অন্যদের কাছে বিক্রি করেন। এভাবে তিনি কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ জনতা মার্কেটটি গুঁড়িয়ে দেয়।
আয়েন উদ্দিন এমপি হয়ে এমদাদকে বড়গাছি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ১৪২ বিঘা জমি। বিপুল পরিমাণ এ জমির লিজের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এ ছাড়া ১০ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। পরে দুর্নীতির বিষয়টি জানাজানি হলে অভিভাবক এবং স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে এমদাদকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হন সাবেক এমপি আয়েন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে এমদাদ আত্মগোপনে চলে যান। এ কারণে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, এমদাদকে পুলিশ খুঁজছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর আইনের আওতায় আনা হবে।
এসআর