চীনের বেইজিং বা পেকিন জাতের হাঁস পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে চরফ্যাশনে। মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি গ্রামীণ বেকার অনেকের ভাগ্য বদলে দিচ্ছে এই পেকিন হাঁস। সৃষ্টি হয়েছে নারী-পুরুষের নতুন কর্মসংস্থান। এই হাঁস পালনে সফলতার মুখ দেখছেন চরফ্যাশনে খামারিরা। সুস্বাদু ও অধিক মাংস উৎপাদনশীল জাতের এই হাঁস দেখতে আকর্ষণীয় এবং অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল। সঠিক পরিচর্যা এবং সুষম খাবারের মাধ্যমে মাত্র ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যেই প্রতিটি হাঁস ২৫ থেকে ৩ কেজি ওজন হয়।
স্থানীয় উন্নয়নসংস্থা “পরিবার উন্নয়ন সংস্থা” (এফডিএ) সহায়তায় চরফ্যাশন উপজেলায় গড়ে উঠেছে শতাধিক পেকিন হাঁসের পারিবারিক খামার। এখানকার গৃহবধূরা সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির উঠানে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কেউ মাচায় আবার কেউ খাঁচায় গড়ে তুলেছেন পারিবারিক খামার। এই দ্রুত বর্ধনশীল হাঁস পালন করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এই উপজেলার শতাধিক পরিবার।
জানা গেছে, চরফ্যাশনের এওয়াজপুর, আমিনাবাদ, চরমাদ্রাজ, হাজারীগঞ্জ, জাহানপুর, দক্ষিণ আইচা, মুজিবনগর, নজরুল নগরসহ চরকলমী ইউনিয়নে ছোট-বড় এই পেকিন হাঁসের খামারগুলো গড়ে উঠেছে। পেকিন জাতের এই হাঁসটি এ অঞ্চলে পূর্বে প্রচলন ছিল না। ২০২০-২১ অর্থবছর হতে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর আর্থিক ও কারিগরী সহযোগিতায় কৃষি ইউনিট (প্রাণিসম্পদ খাত)
এর আওতায় এ পর্যন্ত চরফ্যাশন উপজেলায় একশত গ্রামীণ খামারিদের মাঝে বিনামূল্যে পেকিন হাঁস বিতরণ করে পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ)।
ডা: শাওন চন্দ্র শীল প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, কৃষি ইউনিট (প্রাণিসম্পদ খাত) পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ) জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও চরফ্যাশন উপজেলার জিন্নাগড় ইউনিয়নের কুতুবগঞ্জ গ্রামে এফডিএ- এর সাথী মহিলা সমিতির আওতায় দশটি পরিবারের মধ্যে বিনামূল্যে পেকিন হাঁস, মাচার উপকরণ, খাবার, জীবানুনাশক এবং ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়েছে। বেকার যুবক ও দরিদ্র নারীদের হাঁস পালনে উক্ত সংস্থার মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ করণে পরামর্শ ও মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা, ভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে।
চরফ্যাশন উপজেলার কুতুবগঞ্জ গ্রামের জান্নাত বেগম জানান, “পেকিন হাঁস পালন করে তিনি অনেক লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে বাজারে তিনি প্রতিটি পেকিন হাঁস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। এতে করে সংসারের টুকিটাকি খরচের জন্য এবং সন্তানদের পড়ালেখার বাড়তি খরচের টাকা স্বামীর কাছ থেকে নিতে হচ্ছে না। আগামীতে তিনি আরও বেশি করে পেকিন হাঁস পালন করবেন বলেও
জানান।
বর্তমানে এই গ্রামে তাকে দেখে প্রায় ১০ টিরও অধিক পেকিন হাঁসের খামার অর্থাৎ ক্লাস্টার ভিত্তিক পেকিন হাঁস পালনের খামার গড়ে উঠেছে।
শশীভূষণ থানার রসুলপুর গ্রামের ফাহিমা বেগম বলেন, “আগে দেশি হাঁস পালন করতাম এখন পেঁকিন হাঁস পালন করে ২ থেকে ৩ গুণ লাভ হচ্ছে। সংসারে আগের চেয়ে উন্নতি হচ্ছে।”
চর কলমীর রিতা বেগম বলেন, ৩ বছর আগের থেকে আমি দেশী ২০টি দেশী হাঁস পালনের মাধ্যমে হাঁস পালন শুরু। পরে আমি পরিবার উন্নয়ন সংস্থা হতে ৫০ টি পেকিন হাঁসের বাচ্ছা পাই। তা বিক্রি করে লাভ হওয়াতে আমি ৫০ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ নেই। বর্তমানে আমার ১০০টি পেকিন হাঁস এবং দেশীয় ৩০টি হাঁস রয়েছে। আমার পরিবারের চাহিদানুযায়ী ডিম খেয়ে বিক্রিও করি।
সংস্থাটির প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শাওন চন্দ্র শীল আরো জানান, পেকিন হাঁস একটি আমেরিকান প্রজাতি, যা মূলত মাংসের জন্য লালন-পালন করা হয়। এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনা পাখি থেকে উদ্ভূত এবং এখন বিশ্বের অনেক জায়গায় প্রজনন করা হয়। এটি চীনের পিকিংয়ে (বর্তমান বেইজিং) এ সর্বপ্রথম ডিম পারে তাই এর আরেক নাম বেইজিং হাস। এই হাঁস জলবায়ু সহিষ্ণু এবং এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। পেকিন হাঁস পালনের জন্য মাচা পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর।
উল্লেখ্য, পিকেএসএফ’র অর্থায়নে প্রতি বছরের ন্যায় খামারিদের উৎপাদিত হাঁসের সঠিক দাম নিশ্চিত করতে পাইকার, ফড়িয়া এবং স্থানীয় বাজারে হাঁস বিক্রেতাদের সাথে খামারিদের সংযোগ করতে বাজার সংযোগ কর্মশালা আয়োজন করে থাকে পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ)। এছাড়াও এ বছর ২৫ জন নারীকে পেকিন হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
চরফ্যাশন উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারন কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুর রহিম খান অনিক বলেন, “স্মার্ট লাইভস্টক মানেই স্মার্ট বাংলাদেশ। আর সেই বাংলাদেশ গড়তে আসল ভূমিকায় গ্রামীণ খামারীরা এখন অনেক এগিয়ে। চরফ্যাশনে খামারীদের পেকিন হাঁস পালনে সফলতাই তার জলন্ত প্রমাণ। এভাবে চরফ্যাশনের গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে পরিবার উন্নয়ন সংস্থা (এফডিএ)। সেই সাথে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নিতে এফডিএ -এর এমন উদ্যোগকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই এবং এক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে।
এসআর