মাইনাসে মাইনাসে প্লাস- বীজগণিতের ফর্মুলা। ধ্বনি ও ছন্দে মিল থাকলেও জীবন এবং বীজগণিতের কে কাকে মেনে চলে কিংবা কে করে কারে অনুসরণ সে এক বিরাট প্রশ্ন, ট্রিলিয়নস ডলার তো বটেই।
বৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা- একটি নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ। সময়ের কোন পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা আপনার বিষয়। যদি থাকেন একাত্তরে, আসলে ওটাই শেকড়- সুস্থির হয়ে দাঁড়ান, হৃদয়ের চক্ষু মেলে দেখেন সাদাকালো অতীত।
দুই হাজার চব্বিশে আছি- একই শব্দ বাক্য ছন্দ সুর, দেয়ালে দেয়ালে আঁকা শৈল্পিক আকাঙ্ক্ষাগুলো পড়ে মনে হয়, স্বপ্ন থেকে চলে গিয়েছিলাম বহুদূরে স্বপ্ন হারনোর পথে। দানবের থলিতে রেখেছিলাম সমস্ত সম্পদ। জেগে দেখি সবই হয়েছে লুট। তাই, রক্তে ভেজা চিরচেনা মেঠো পথে পা বাড়ালাম আবার।
গন্তব্যের ঠিকানা বলছি- সাম্যের বাড়ি, গ্রাম পোস্টাফিস জানা নেই। আবার বলতেও লাগে ভয়, সারা পথ জুড়ে বসে আছে মানুষরূপী রাক্ষস খোক্কস দেও দানবেরা। ওদের বেশির ভাগই দেশীয় দালাল, বিদেশি সামান্য সংখ্যক- তবে খোলনলচে ট্রিগার সব ওদেরই হাতে, যেমন ছিল বড়ো-ছোট মিলে দুইশত বছর ঔপনিবেশিক আমলে।
মূল কথায় আসি এবার- বৈষম্যের অবসান চাই। সাম্য প্রতিষ্ঠার সাহস আছে কি? প্রভুদের সুগারকোটেড বড়ি গিলে গিলে হয়েছি অভ্যস্ত- ঠোঁট নড়ে, তো শব্দ বের হয় না। মুক্তিযুদ্ধত্তোর রক্তে ভেজা উর্বর জমিনে সাম্যের বীজ বপণ করিনি। শোষণের সব ব্যাকরণ ঠিক রেখে চালিয়ে গেলাম ঘর গেরস্থালি থেকে শুরু করে রাজনীতি অর্থনীতি।
বৈষম্যকে ধরে নিলাম গতির স্বাভাবিক ফল- বেশি বড় হলে বেখাপ্পা লাগে, স্বাদেও লাগে তিতা। তাই তো মাঝে মধ্যে রুচি বদলাই- দারিদ্রের ঘন ডালে করমচা মিশিয়ে পাতলা করি, যেন পদার্থ রসায়নের ফর্মূলা অনুযায়ী না ঘটে বিস্ফোরণ। স্থিতিশীলতা রক্ষার দোহাই দিয়ে আগুন নিভানোর মহাআয়োজনে ঘর্মাক্ত হই, পাপভূমি পুড়িয়ে পূণ্যের চাষবাসের উপযোগী করি না। কারণ সে সাহস আমাদের সংগ্রামে এখন নেই, যা ছিল আগে। পুরানো জমিদার বাড়ির শেওলা জমা উঠান আঙ্গিনা দেয়ালে মিশে গিয়েছে সব।
সাহসের আসল ভিত্তি- মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জ্ঞানের বিকাশ হয়নি গত অর্ধশত বছরে। আসলে আমরা সামষ্টিক ভাবে চাইনি তা তৈরি করতে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো- বাংলাদেশের ব্যক্তি মানুষ এবং সামষ্টিক অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মানুষ এ দু'য়ের মধ্যে যোজন যোজন ফাঁক। ব্যক্তির টিকে থাকার প্লবতা (resilience) বেশি থাকলেও রাষ্ট্র ভঙ্গুরতাও ব্যাপক। এ কূটাভাস (Paradox) ব্যাখ্যা করতে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন। বহু দীর্ঘ ইতিহাস নাই বা নিলাম আমলে। বিগত তিপ্পান্ন বছরে আন্দোলন সংগামে রক্ত ঝরানো, জীবন বলিদান তো হয়েছে অনেক- এবং সবই হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ক্ষমতার অধিকারে বৈষম্য বিলুপ্তকরণের নামে। সরাসরি সাম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা এখানে অনুপস্থিত। কেননা সে সাহস আমাদের ছিল না এবং এখনো নেই। তাই তো দুটোই রয়ে গেছে অধরা- কবি মোহাম্মদ রফিকের ‘খোলা কবিতা’র পঙক্তির উদৃতি দিয়ে বলা যায়- ‘নেতানো নুনুর গায়ে হাত রেখে বলো স্বাধীনতা চাই!’। সাহসের ভিত শক্ত না করে সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলা সবচেয়ে অসার কথাই শুধু নয়, চরম মুনাফেকিও বটে।
আগেই বলেছি সাহসের কেন্দ্রে থাকে ভালোবাসা ও জ্ঞান। এ দু’টোর চাষবাসের আবশ্যিক দায়িত্ব সমাজের। সুদীর্ঘকাল আমরা এদিকে নজর না দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির উপায় লাভে ছিলাম মোহগ্রস্ত। এখন দেখি যেন নেশায় আসক্ত বিকারগস্ত এক সামাজিক ব্যবস্থা। এর থেকে উত্তরণের উপায় দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রস্তুতি- দেশপ্রেমিক মানুষ গড়া।
সৈয়দ শামসুল হকের অনবদ্য সৃষ্টি– ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’ কাব্য নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র, নূরুলদীনের বাল্যবন্ধু, আব্বাসের একটি দীর্ঘ সংলাপ বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক– “...........
গোড়া হতে ধীরে ধীরে গড়ি তোলো দেশের সন্তান,
এমন মাটিতে করো সবাকে নির্মাণ
য্যান তারা জমিদার মহাজন কি নবাব না হয়,
য্যান তারা হাসিমুখে ভাগ করে খায় অন্নপান,
গোরা তো বিদেশী, বাহে,
নবাব কি মহাজন বিদেশী তো নয়,
হামার মতো তারও জন্ম এই দ্যাশে হয়।
কও কি নিশ্চয় আছে, হামারে ভিতর থেকি
আবার হবার নয়
অত্যাচারী জন,
যদি না পায়ের মাটি শক্ত করো, ধৈর্য ধরি করো
আন্দোলন?-
লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিম্বা কয়েক জীবন?”
এখানেও দেখা দেয় আর এক বৈপরীত্য- রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করলে সমাজ গড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না, আবার দূর্বল ভীরুদের নিয়ে কাকতালীয় ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা পেলেও তা টেকসই হবে না সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। দূর্বল ভীরুরা না হয় দূরেই থাক, চালাক-চতুরদের দ্বারা কি সাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, সম্ভব না। এ পথ ব্যর্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবকালে। এ পথ ব্যর্থ হয়েছে স্বৈরাচারী হাসিনার চরম চালাকি ও প্রতারণাপূর্ণ কূটবুদ্ধিতে। একইভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানেত্তোর চালাকি-চাতুরীর পথ ধরে ইসলামি রাষ্ট্র কিংবা সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও ব্যর্থ হতে বাধ্য। সঠিক উপায় হলো- শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলকে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, একই পাটাতনে দেশপ্রেমের ফ্রেমে একাত্ম করা। মনে রাখা আবশ্যক যে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে- অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দর্শনে উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত হওয়া। এর বিপরীত হবে- পুরনো সেই ঔপনিবেশিক জোঁয়াল কাঁধে নেওয়া!!
সাম্য শব্দটি ছোট, কিন্তু ওজনে ভারী ও বহুমাত্রিক। জন্মগত ভাবে সকলেই সমান- এটিই সাম্যের প্রথম ভিত। এরপর প্রত্যেককে যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া ও যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটি নিশ্চিত করতে হলে হাত দিতে হবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের পুনর্বণ্টনের কাজে অর্থাৎ সম্পদশালীদের নিকট থেকে মালিকানা ছাড়িয়ে নিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো শাসন পর্বেই তা তো হয়ই নি বরং ঘটেছে উল্টো ঘটনা; অথচ শাসনতন্ত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা লেখা ছিল সুস্পষ্ট সাদা কালো অক্ষরে। আবারো বলছি- ‘সাম্য হবে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌল দর্শন’। কিন্তু, বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ব্যবস্থার ধরণ, রাজনৈতিক অর্থনীতির দর্শন বিবেচনায় এটি কথামালার সুললিত সুর ঝংকার হতে পারে, বাস্তবতার প্রতিফলন হবে না। এ পথে হাঁটার সাহস যে হবে না তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়।
এবার ঋণাত্মক দিক থেকে ধণাত্মক দিকে যাওয়া অর্থাৎ আয় বৈষম্য দূর করতে করতে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক। মানুষ যদি মানব সম্পদে রূপান্তরিত না হয় বাজারে তার মুল্য নেই, তার মানে সে কাজ পাবে না, আয়ও আসবে না। মানব সম্পদ তৈরির পুরো দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। কিন্তু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে যেভাবে বাজারিকরণ করা হয়েছে তাতে এ কাজে হাত দেওয়ার সাহস পাওয়া যাবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আসলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো অসম্ভব বলেই প্রতিভাত হয়। বরং যুগের ধারায় তাল মিলিয়ে বড়জোর বাড়িয়ে দিতে পারি মানবিক হাত- পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার যাতাকলে যারা হবে নিষ্পেষিত, যারা হবে অপাঙ্গতেয়, অপ্রাসঙ্গিক তাদেরকে দিতে হবে ঠাঁই। একে সামাজিক সুরক্ষা নাম দিয়ে দারস্থ হতে পারি কর্পোরেট দয়াদাক্ষিণ্যের কাছে অর্থের জন্য। এক-দু’ফোঁটা যা চুঁইয়ে পড়ে, তা নিয়েই থাকতে হবে সন্তুষ্ট- প্রাণ আছে বেঁচে, আর কী চাই, কোন সাহসে!
সবই আছে আমার চোখের সামনে, প্রবেশাধিকারটা সীমিত, মালিকানা প্রতিষ্ঠা- সে তো বহুদূর! সে সাহস নেই কারোরই। তাহলে কেন করি বিলাপ, কেন চাই- জীবনের সবুজ কচি পাতা চোখ মেলে দেখুক রোদ্দুর, বাতাসের তালে তালে হেলে দুলে লুটোপুটি খেয়ে নুয়ে পড়ে সখ্য গড়ুক মাটির সাথে, আলোর সাথে।
নিজের ভেতরের আলো না থাকলে কিংবা থাকলেও তা না জ্বালিয়ে তারার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে কোনো লাভ নেই- এটা ইতিহাসের শিক্ষা বলে, ভূগোলের সমুদ্র স্রোত বলে, বায়ু প্রবাহের ঘূর্ণিপাক বলে, সাধারণ ঘর-গেরস্থালির ব্যাকরণও বলে তাই।
ঈগলের নখরে গেঁথে থাকা হলুদ তুলতুলে মুরগীর বাচ্চা আকাশে উড়ে, নক্ষত্রের সাথে মিতালী গড়তে ভাসতে থাকে মেঘের কিনার ধরে- নীচে পড়ে থাকে মরুভূমির কান্নার কঠিন স্তর, সভ্যতার শিলালিপিতে আঁকা মায়ের শংকা ও ভালোবাসার আকুতি।
এমএ