শেরপুরের গারো পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সাথে বন্যহাতির দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দুই যুগেও সমাধান করা হয়নি। বন্যহাতির নিরাপদে চলাচল করার জন্য গড়ে উঠেনি অভয়ারণ্য কিংবা সোলার ফেন্সিং কার্যক্রম। ফলে গারো পাহাড়ি গ্রামবাসীরা বিগত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে জানমাল রক্ষা করা নিয়ে রয়েছেন চরম বিপাকে। মাঝে মধ্যেই হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। একইসাথে মারা পরছে বন্যহাতিও। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এলাকাবাসীর ঘরবাড়ি ও আবাদী ফসল। গ্রামবাসীরা মানুষ আর হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি জোড় দাবী জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২০০০ সালে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা জুড়ে ৫০টি গ্রামে শুরু হয় বন্যহাতির তান্ডব। এসব পাহাড়ি গ্রামগুলোতে মুসলিম, গারো, হাজং, কোচ, বানাই বর্মন ও হিন্দুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় মানুষজন মিলে প্রায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। এদের বেশির ভাগ মানুষই শ্রমজীবিও কৃষির উপর নির্ভরশীল। গত দুই যুগ ধরে উপুর্যপুরি বন্যহাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি, গাছপালা, সবজি বাগান, খেতের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা জানান, প্রায় শতাধিক বন্যহাতির দল দিনের বেলায় গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেয়। আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয় ও ফসলী জমিতে। কৃষকরা তাদের খেতের ফসল ও জানমাল রক্ষার্থে রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছেন। সনাতন পদ্ধতিতে ঢাকঢোল পটকা ফুটিয়ে ও মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে ততোই বন্য হাতির দল পালাক্রমে তান্ডব চালাচ্ছে বাড়িঘরে। কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না বন্যহাতিদের। প্রতিরোধ গড়ে তুলেও রক্ষা করা যাচ্ছে না ঘরবাড়ি ও খেতের ফসল। দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে আতঙ্কে রাত কাটছে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের।
সংশ্লিষ্ট গ্রামবাসীরা আরো জানান, বন্যহাতির জন্য গারো পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় পেটের ক্ষুধা নিবারনের জন্য মাঝে মধ্যেই লোকালয় হামলা করছে। এদিকে, বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীর ঘরে খাবার না থাকলেও রাতে হাতি তাড়ানোর জন্য মশাল জ্বালাতে কেরোসিন তেল ঘরে রাখা যেন বাধ্যতামূলক। পাহাড়ি এলাকায় আবাদকৃত ধান পেকে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে হাতির তান্ডব বৃদ্ধি পায়। হাতির তান্ডবে খেতের ফসল ঘরে তুলতে পারে না কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যহাতির তান্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শতশত একর আবাদি জমি পতিত পরে থাকে। এতে চরম বিপাকে রয়েছেন এলাকার কৃষকরা। যদিও বন্যহাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু ও ফসলের ক্ষতিপুরণ দেওয়া হচ্ছে বনবিভাগের পক্ষ থেকে।
উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বুরুঙ্গা কালাপানি গ্রামের বাসিন্দা উকিল উদ্দিন, এরশাদ আলম ও বাদশা মিয়াসহ বেশ কয়েক জন জানান, ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ক্ষতিগ্রস্থদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। কেননা পাহাড়ি এলাকায় বেশির ভাগ জমি ‘খ’ তফসিলভুক্ত। যা আগে শত্রু সম্পত্তি ছিল। বন্যহাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ জমি রেকর্ডীয় না হলে ক্ষতিপুরন দেওয়া হয় না। তাই এসব ঝামেলা পোহাতে চান না কৃষকরা। আবার কেউ কেউ আবেদন করে বছরের পর বছর ঘুরছেন। এমন অভিযোগ করেছেন অনেক কৃষক। এছাড়া পাহাড়ি গ্রামগুলোতে এলোটম্যান্ট ও সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত জমির পরিমান বেশি। তাই কাগজপত্রের জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ভাগ্যে জুটছে না ক্ষতিপূরণের টাকা।
অপরদিকে, বনবিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে মানুষ-বন্যহাতির দ্বন্দ্ব নিরসন করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ২৫ টি ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য রয়েছে। তারা এলাকায় জনসচেতনা বৃদ্ধি করে মানুষ হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা না থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছে এই কমিটির কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গারো পাহাড়ের বন্যহাতির আদি নিবাস পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। ওই দেশের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে বিশাল এলাকা জুড়ে এককালে ছিল বনভূমি। এসব বনভূমি কেটে পরিস্কার করে বিভিন্ন প্রজাতির ফসলাদি উৎপাদনের কাজ হাতে নেয় ভারত সরকার। শুধু তাই নয় বনভূমিতে ফসল উৎপাদন ও সীমান্তে কাটা তারের বেড়া নির্মাণের কারণে বন্যহাতির দল ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে শেরপুর সীমান্তে অবরুদ্ধ হয়ে পরেছে বন্যহাতির দল। তারা তাদের আদি নিবাসে ফেরত যেতে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের স্বল্প বনভূমি এলাকায় চলাচল করতে ক্ষুধা নিবারন করতে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। আর খাবারের সন্ধানে যখন পাহাড়ি এলাকার ধানখেতে হাতির দল হানা দেয় তখন কৃষক ফসল বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আর তখনই শুরু হয় হাতি আর মানুষের মাঝে মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে বন এলাকায় কাঁটাযুক্ত বেত বাগান সৃজন প্রকল্প ও কিছু এলাকায় সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প হাতে নিলেও কোন কাজ হয়নি।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই দেশের পররাষ্ট্র ও বনবিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের যৌথ সভায় বন্যহাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে। তাছাড়া গারো পাহাড়ে বন বিভাগের ২০ হাজার একর বনভূমি থাকলেও বিপুল পরিমাণের বনের জমি বেদখল ও প্রাকৃতিক বন না থাকায় বন্যহাতির আভাসস্থল সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্য সংকটে রয়েছে বন্যহাতি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গারো পাহাড়ের গহীণ অরণ্যে ১২০টির মতো বন্যহাতি অবস্থান করছে। পর্যাপ্ত খাদ্য ভান্ডার না থাকায় চরমভাবে খাদ্য সংকটে রয়েছে বন্যহাতির দল। হাতির তান্ডব শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে তাদের জানমাল রক্ষার্থে হাতির খাদ্য ভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য সোলার ফ্যান্সিং স্থাপনের দাবি জানানো হয় সরকারের কাছে। কিন্তু গত দুই যুগেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
শেরপুর জেলা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে ২০১৪ সালের পরে এ পর্যন্ত মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বে হাতির আক্রমনে ৪২ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকই। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৩টি বন্যহাতিরও। মানুষ-বন্যহাতি দ্বন্দ্বের কারণেই এসব মানুষ হাতি হতাহতের ঘটনা ঘটে। মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে বনবিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে ২৫ টি ইআরটি এ্যালিফেন্ট এছাড়া ২০১৬ সালে গারো পাহাড়ের সীমান্তের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতি কবলিত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে স্থাপন করা হয় সোলার ফ্যান্সিং (বৈদ্যুতিক তারের বেড়া)। যা দিয়ে হাতি আক্রান্ত হবে, কিন্তু মারা যাবে না। ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ সোলার ফেন্সিং স্থাপন করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় হয় কয়েক কোটি টাকা। বনবিভাগের বন্য প্রাণী অধিদপ্তরে তদারকিতে এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঝিনাইগাতীর গুরুচরণ দুধনই গ্রামে ৪.৫ কিলোমিটার, ছোট গজনী গ্রামে ৩ কিলোমিটার, বড় গজনী-হালচাটি গ্রামে ৩.৫ কিলোমিটার এবং নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের মায়াঘাসি এলাকায় ২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থাপন করা হয় সোলার ফ্যান্সিং। কিন্তু ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করায় ও অযত্ন অবহেলায় নির্মান কাজ শেষ হতে না হতেই তা অকেজো হয়ে পড়ে। এই কার্যক্রম কোন কাজে আসছে না গ্রামবাসীদের।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, গারো পাহাড়ে মানুষকে যেমন থাকতে হবে, বাঁচতে হবে। বন্য হাতিদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানোর পরিকল্পনা আছে।
তিনি বলেন, ইআরটি টিমগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহন করা হবে। বনাঞ্চলের আশপাশের এলাকায় সরকারি খাস খতিয়ানের কিংবা বনবিভাগের জমি রয়েছে। সে কারণে সেখানে বসবাসকারীদের ক্ষতিপূরণ পেতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হাতির তান্ডবে আবাদ ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কিভাবে সহজিকরণ করা যায় পরিকল্পনা গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনম. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এ পর্যন্ত বন্যহাতির আক্রমণে নিহত, আহত ও আবাদ-ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ২০০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সেইসাথে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি ও সহজিকরণের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শেরপুর সীমান্তে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে অভয়ারণ্যের বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। তবে বনবিভাগের ২২ হাজার হেক্টর জমি ছাড়াও বনাঞ্চলে হাতি চলাচলের পথে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর খাস খতিয়ানের এবং প্রায় দুই হাজার হেক্টর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি রয়েছে। সেইসব ভূমি অধিগ্রহনের অনেক খরচ। যে কারণে এখনও হাতির অভয়ারণ্য সৃজন করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিকল্পনাটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এসআর