আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যার, মাইক্রো ইকোনমিকস পড়াতেন মাস্টার্সে। ক্লাসে এসে ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকতেন সিম্পল দু'একটা রেখা, সাথে সমীকরণ– প্রথমে কিছুই বুঝতাম না, পঁয়তাল্লিশ মিনিট শেষে বুঝতাম যে, জটিল তত্ত্বের গাণিতিক মডেল তাৎপর্যসহ কত সহজে শিখিয়ে গেলেন স্যার, যা আগে বুঝতে গিয়ে মাথার চুল টেনে ছেঁড়ার অবস্থা হতো। তো স্যার একদিন পড়ানোর ফাঁকে প্রশ্ন করলেন– ধরো, কোনো এক দুর্ঘটনায় অর্থনীতির একটি বই ছাড়া সবগুলো পুড়ে ছাই হলো; কিন্তু, অর্থনীতি আবারো আজকের জায়গায় ফিরে এলো– কোন বইটি বেঁচে থাকলে তা সম্ভব? আমরা সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লাম, এ আবার কেমন প্রশ্নরে বাবা! আমাদের শূন্যে তাকানো দেখে স্যার স্বভাবসুলভ এক চিলতে হাসি হেসে বললেন, বইটি হলো– জে আর হিকসের ‘ভ্যালু এন্ড ক্যাপিটাল’। এরপর ফুলার রোডে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে বইটি সংগ্রহ করে বহু কষ্টে বারবার পড়ে উপলব্ধি করেছি স্যারের প্রজ্ঞা।
বাংলাদেশের রাজনীতির নষ্ট অবস্থা দেখতে দেখতে আমার মনে একটি প্রশ্ন বারবার উঁকি দেয় বহুদিন আগে থেকেই, যা এই প্রৌঢ়বেলা বলতে চাই– হঠাৎ আগুন লেগে রাজনীতিবিষয়ক কোন বইগুলো পুড়ে গেলে আমরা রাজনীতির সুস্থ ধারা ফিরে পাবো? আপনাদের কার কী মনে হয় জানি না, তবে আমার মনে জাগে, ম্যাকিয়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’ বইটির ডিএনএ ডালপালাসহ সবগুলো কপি পুড়ে ছাই হলে (কোন বই ধ্বংস করা বা নিষিদ্ধ করা হোক তা কখনো সমর্থন করি না) হয়তো বা তা সম্ভব। আসলে সেটা সম্ভব কিনা তার সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। যুগ যুগ ধরে শাসকগণ ‘সিংহের মতো সাহসী ও শৃগালের ন্যায় ধূর্ত’ হতে গিয়ে কিংবা ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে যেকোন উপায় শুদ্ধ’- এ আপ্তবাক্য প্রয়োগের চর্চা করতে করতে শাসন ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছে! রাজা-প্রজার যুগে হয়তোবা ঐ ব্যাকরণ দিয়েছে ধ্বনন্তরি নিদান, যখন শাসিতের কোন স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ ছিল না কিংবা তা দাবিয়ে রাখা হতো নানা শক্তি প্রয়োগ করে।
কিন্তু, ফরাসী বিপ্লবের পরে–পশ্চিমা বিশ্বে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর, বলতে গেলে, পৃথিবীজুড়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের যে হাওয়া বইতে শুরু করল, প্রজারাও হলো এ ব্যবস্থার অংশীদার, সেখানে শাসকের জন্য ‘ম্যাকিয়াভেলি তত্ত্ব’ স্ববিরোধীও বটে। তবুও কেন তা চলে আসছে, সে এক বিরাট প্রশ্ন। অবশ্য বিপরীত চিত্রও ছিল আমাদের প্রাচ্যের দেশগুলোতে যেখানে বহু আগে থেকেই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র – রাজনৈতিক অর্থনীতি; কনফুসিয়াসের রাষ্ট্র দর্শন, খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসন ব্যবস্থার উদাহরণ ছিল অন্ধকারে আলোকবর্তিকার মতো।
সারা বিশ্বে বড়ো বড়ো রাজ্য-সাম্রাজ্যের যুগে প্রজাপীড়ন, যুদ্ধবিগ্রহ এমনকি দু'দুটো মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পার করলো শতবর্ষের অধিককাল। কিন্তু, গণতন্ত্র হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা তো সাপলুডু খেলার মতো! কেন এমন হয়?– এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে নির্মোহভাবে।
আমি মনে করি, গ্রাম্য রাজনীতির গভীর পাঠ এ ক্ষেত্রে হতে পারে কার্যকর উপায়। এটি হলো রাজনীতির নিউক্লিয়াস– উহার পরিধি বড়ো হতে হতে গ্রাম থেকে দেশ, দেশ থেকে বিশ্বরাজনীতি– বিন্দু থেকে সিন্ধু যেমন।
রাজনীতির দেহকাঠামো-আত্মা, হোক না তা আনুষ্ঠানিক কিংবা উপানুষ্ঠানিক– পুরোটাই জুড়ে থাকে শক্তির খেলা। শক্তির মৌল চরিত্র পদার্থ বিজ্ঞানে যা, সমাজ বিজ্ঞান বা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেও তাই, তবে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে গেছেন–‘রাজনীতি হলো হাজারগুন কঠিন’।
সমাজের অন্য সকল সংগঠন থেকে রাজনৈতিক দল যে আলাদা, তা চেনার মৌল উপাদান এই – সে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিয়ে নীতি ও আদর্শের বাস্তবায়ন করতে চায়, যেখানে অন্য সংগঠনগুলো শুধু প্রভাব বিস্তারে সীমিত থাকে। শক্তির তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে যেমন আলো জ্বালিয়ে দূর করা যায় অন্ধকার, তেমনি আলোকিত প্রাণবন্ত সবকিছুই ধ্বংস করে কায়েম করা যায় শয়তানের রাজত্ব– দাসপ্রথার যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, অবশ্য আমাদের অনেকেই বলি উত্তরাধুনিক যুগ, সকল ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রও একই পথ দিয়েছে পাড়ি– ঔপনিবেশিক যুগে চতুর এক দল মানুষ দালালি করে ক্ষমতার কেন্দ্রে গাঁটছড়া বেঁধে তেলেঝোলে, সাথে চমক লাগানো উপাধি নিয়ে, আয়েশি জীবন পার করেছে। নিরীহ আর এক দল লোক কোনরকম কায়দা করে বেঁচে থেকেছে। এ দু’দল সংখ্যায় অনেক ভারী হলেও বিরুদ্ধ স্রোতে হেঁটে স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদানকারী তৃতীয় দলটি ছিল ঔজ্জ্বল্যে বিস্তৃত– ওঁদের জন্যই আজ আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি, সংস্কারের চিন্তা করছি এবং পথনকশা আঁকছি।
গ্রামের বিরল বৈশিষ্ট্য হলো, সকলেই চিনে সবাইকে– কোন দুধেল গাভী লালনপালন করে ফজল, ঝুঁটিওয়ালা লাল মোরগের মালিক যে ছমিরন বেওয়া– তা নয় কারো অজানা। খেতের বাতর (আইল) ঠেলাঠেলি নিয়ে শুরু হয় বিরোধ, সমস্ত শালিস-দরবার পার করে সেটি আদালতের হাকিম বাহাদুর পর্যন্ত গড়ায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আগে এমনটি ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু জনপদ বাস করতো গাঙেয় বদ্বীপে– সামান্য ঝগড়া ফ্যাসাদ ছাড়া বড়ো কোন সংকট দেখা দিত না, দেখা দিলেও সমাজই নিজ নিয়মে মিটিয়ে ফেলত সব। বিদেশীদের শেখানো আইনের গেঁড়াকলে পড়ে নিঃস্ব হতে হতে আমাদের রাজনীতির হাতে খড়ি। তাই তো ঝগড়া সকালে শুরু হলে চলে রাত অবধি, অবশ্য বিরতি দিয়ে ঘুমাতে যাই; আবারো শুরু করি গোড়া থেকে – এ চক্করের শেষ না পাই!
ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাণিজ্য করলো, লুণ্ঠন করলো আমার বুক চিরে, কিন্তু আমি নিজে ব্যবসা শিখলাম না। অথচ লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসন নীতি রপ্ত করলাম মনে ও মগজে – এখনো চালিয়ে যাচ্ছি, তলোয়ারে শান দিয়ে দিয়ে ঠিক রাখছি কতল করবার ধার। সেই যে উনিশ শ সাতচল্লিশে ধর্মের সুতো ধরে অধার্মিকদের দ্বারা দেশভাগ–বিভাজনের রাজনীতি শুরু, চলছে হরদম, অবশ্য আমরাই ফুঁ দিয়ে আগুন জিইয়ে রাখছি বারবার মহাউল্লাসে। এ রাজনীতি শেষ হওয়া তো দূরের কথা, দানবের মতো দিন দিন বড়ো হচ্ছে এর হা করা মুখ, ধারালো হচ্ছে দাঁত! একটা সময় এসেছিল একাত্তরে – বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র সাহসে রক্তস্রোতে মিলেমিশে একাত্ম হবার। বড়ো দুর্ভাগ্য! পবিত্র ধারায় শামিল হলাম না তো বটেই; বরং উল্টো স্রোতে গা ভাসালাম।
রাজনীতির ভেল্কিবাজি খেলায় নিমগ্ন হলাম, ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের চিরায়ত মডেল মুখস্থ করলাম– যা বিশ্বাস করি মনে, মুখে বলি তার বিপরীত; গণতন্ত্রের নাম জপে জপে মুখে ফেনা তুলি, কিন্তু নিজের দলে তা চর্চা তো করিই না, উল্টো জল ঢালি বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের গোড়ায়– নেতানো গাছকে দাঁড় করিয়ে রাখি মহীরুহ বলে, জনতার ভালোবাসার ছায়াতল নাম দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখি কুটিল আবরণে। ধর্মীয় মৌলবাদের ভয়ংকর অবস্থাতো প্রত্যক্ষ করছি আশেপাশের দেশগুলোতে। এখানে মনে ভেসে ওঠে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের তিনটি ট্র্যাজেডি নাটক –’রিচার্ড III’ ‘‘দ্য ম্যাকবেথ’ এবং ‘হ্যামলেট’ এ অংকিত চিত্রের নির্যাস– যেখানে ক্ষমতার মোহগ্রস্থ হয়ে রাজসিংহাসন দখলের ভয়ানক সহিংসতা, হত্যাযজ্ঞ ও যুদ্ধ-খেলা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে অত্যাচারী শাসকের হাতে ন্যায়পরায়নতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিরীহ প্রজা তথা জনতাকে ফেলে দেয়া হয় দীর্ঘকালীন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সাগরে; যেন – ‘জনতা! নামহীন অবয়বহীন একটা জন্তু’। বর্তমানকালে আমাদের শাসকগোষ্ঠী গণতন্ত্রের সাথে প্রতারণা করে এ ‘জন্তুকে’ই লাইন ধরিয়ে ভরায় ভোটের বাক্স, কিংবা নানা কৌশলে তাদেরকে দূরে রেখে ক্ষমতার তথাকথিত বৈধতার সনদ নেয়; আবার প্রয়োজন হলে এদেরকে জড়ো করে রাজপথ উত্তপ্ত করে গনগনে আগুনে– সাজানো ফুলের বাগান তছনছ করে, এ যেন বেয়াড়া ষাঁড়ের স্বাধীনতা উপভোগ!
আচ্ছা, এতো উপমা ছেড়ে সরাসরি আসি রাজনীতির খেলার মাঠে– নবীন প্রবীণ কচি খোকা(খুকি) সকলেই খেলছে, ক্ষমতা দখল করতে চায় সবাই। তবে খেলার নিয়মকানুন ঠিক করা হয়নি এখনো – পুরাতন নিয়ম রাখবো না বলছি মুখে সবাই, আবার দল গড়ছি দল ভাঙছি, জায়গা ফাঁকা করছি, দখল করছি দুর্বৃত্তায়ন ও কালো টাকার সম্মোহনী জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে। আবারও মনে পড়ে গেল আমাদের হাইস্কুলের বাংলা শিক্ষক, বিধান চন্দ্র পাল স্যারের কথা; ব্যাকরণের সব নিয়মকানুন– সন্ধি, সমাস, কারক শিখাতেন সুক্ষ্মভাবে, পরীক্ষার খাতা দেখে নম্বর দিতেন হাতের কর গুনে গুনে। তবে পাস নম্বরের জন্য একটা জানালা খোলা রাখতেন সবসময়, ব্যাকরণের নিয়ম মেনে– নিপাতনেসিদ্ধ নাম দিয়ে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো যখন খেলার নিয়ম মানে না কিংবা কোন অদৃশ্য হাত ঘুটি চেলে নিয়ম ভাঙতে প্ররোচিত করে, তখন রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে প্রয়োগ করা হয় নিপাতনেসিদ্ধ নিয়ম। আমাদের নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে এ নিয়ম ব্যবহার করতে করতে হাত পাকা করে ফেলেছি– চারাগাছ ভালোবাসি, তাই তাকে বড়ো হতে দেই না।
গ্রামে কথায় ফিরে আসি আবার– কবি জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীকে সাথে নিতেই হবে। কেননা, নিখাদ ভালোবাসা ও শব্দের এমন বোধ-সংযোগ আর পাবো কিনা সংশয় আছে প্রচুর। তবে আমাদের এই দেশেই কথামালার সুললিত সুরের আবরণ দিয়ে কুটিল মন ঢেকে রাখার রাজনীতি-খেলা চলে আসছে এবং তা চলবে বহুদিন, বলা যায় নিশ্চিত। নিয়মটা চিরায়ত– আগে ঝগড়া-ফ্যাসাদ-দাঙ্গা লাগাও, তারপর মলম লাগিয়ে শাসনের কেরামতি দেখাও; এতে দু'চারটে প্রাণ, এমনকি শতেক হাজার বিনাশ হলেও থাক নির্বিকার। জলবায়ুর পরিবর্তন হবে, নদী মরে যাবে, উর্বর জমি উষর হবে কিন্তু, তুমি থাকবে পর্বতের চূড়ার মতো নিশ্চল। গণহত্যার পরেও তোমার অন্তর কাঁপবে না– উল্টো শুনাবে দেশপ্রেমের গীত। ব্রিটিশের মানচিত্রে যখন ছিলে, ওটা টিকিয়ে রাখার জন্য দালালী করা ধর্ম বটে, পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার অজুহাতে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনসহ দালালী করা– সে তো নিশ্চয়ই দশ ধাপ এগিয়ে।
আমাদের বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে দরকার হলো দালাল শ্রেণিকে নির্মূল করা; দরকার হ’ল– গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা, ওঁদের রক্তের ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতা স্বীকার করে মাতৃভূমিকে ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শ্রেণির সীসাগলা ঐক্যের প্রাচীর, ডলার-টাকা দিয়ে বেচাকেনা করা যাবে না তা। কিন্তু, বাস্তবে হচ্ছেটা কী? একটি গ্রামীণ প্রবাদ আছে – ‘আসল ঘরে ফসল নাই, ঢেঁকি ঘরে চান্দোয়া’। কুটিল রাজনীতি ঠিক করা নিয়ে কথা বলার সাহস নেই, কাজ করা তো দূরের বিষয়, আসলে চলছি দুর্জনদেরকেই সাথে নিয়ে; অথচ মেতে আছি রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন নিয়ে। মনে রাখা আবশ্যক যে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অস্থিমজ্জা-কাঠামো হঠাৎ করে আকাশ থেকে নেমে আসে নি। হঠাৎ আকাশ ফোঁড়ে নেমে আসা দেবতা বা অসুর তা বদলাতেও পারবে না। তবে হ্যাঁ, রাজনীতির কর্কট রোগ নিরাময়ের জন্য কিছু ঝাড়ফুঁক তো লাগবেই। কিন্তু, বিদেশী বৈদ্যের বড়ি গিলে কাজ হবে কিনা বলতে পারবে তা আগামীর সময়, যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলে – হবে না। রাষ্ট্র বাঁচাতে হলে– রাজনীতি শুদ্ধ করতেই হবে, বিরাজনীতিকরণ অবশ্যই নয়; এবং উহার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। বিদ্যমান নষ্ট রাজনীতির চোরাবালিতে পা দিলে রাষ্ট্র টিকবে না; তখন কার সংস্কার করবো!
রাজনীতি প্রসঙ্গে পাঁচ বছর আগে লেখা আমার একটা কবিতা বলে শেষ করতে চাই –
‘কালো পর্দায় ঢাকা যাদুর বাক্স থেকে
হাতের তুড়িতে কিংবা চোখের ইশারায়
বের হতে থাকে চমকের পর চমক,
জীবনকে দুফাঁক করে ফেলে রাখে!
রক্ত ঝরে! কাটামুন্ডু মুঠিতে ধরে
যাদুকর হাসে জল্লাদের হাসি!
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে
দর্শক-জনতা দু'হাতে ঢাকে মুখ,
যাদুকরের কড়া ধমকে সম্মোহিত
সকলে কোচড় থেকে বের করে
সিকি আধুলি টাকা-আনা-পাই,
ঢেলে দেয় বাক্সের বেদীতে;
জীবনকে ফিরে পেতে জীবন
জপমালা পাঠ করে কোহকি শক্তির
তাতেই স্থাপন করে অন্তরের আস্থা,
স্বপ্নের জাল বুনে আশায় বাধে বুক
করাত দিয়ে কাটা জীবন-
যেন আবার জেগে উঠে,
রক্তের ফোঁটাগুলো
যেন ফুল হয়ে ফুটে।
সুবাস ছড়ায় যেন বাতাসের শরীর,
জীবন আর বাতাসের সৌরভে
যেন উদ্ভাসিত হয় সমস্ত জনপদ।
জনতার নাড়ীর টানের দুর্বলতা
ধরে ফেলে যাদুকর, তাইতো-
জীবনকে জিম্মি করে আর
জনতাকে করে ফালি ফালি,
জীবনকে কেটে জোড়া লাগায়
আবার কেটে চমক দেখায়,
যাদুকরের হাতের তুড়ির ঘূর্ণিপাকে
বন্দী হয় জনতা, বন্দী থাকে-
রাজনীতির যাদুর বাক্সে।’
শেষ করতে চাইলেই সবকিছু কি শেষ করা যায়? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য যেমন–
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’; তেমনি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা–‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে–এই
বাংলায়’ এর অন্তর্নিহিত অর্থ – মুক্তির সংগ্রাম নিরন্তর।
২৫ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকা।