দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছের আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে। প্রতি বছর বাংলা মাস চৈত্রের প্রথম দিকে নদীতে মাছের আগমন ঘটে। নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল যেমন—মাতা মুহুরী, সাঙ্গু, কর্ণফুলী, চেংখালী, পোরাকপালি, কাটাখালী, বোয়ালিয়া, সোনাই প্রভৃতি খাল ও নদীর খাড়িতে অবস্থানকারী মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়তে চলে আসে।
বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা বাড়লে পানির ঘোলাভাব বৃদ্ধি পায়। তখন নদীর কুম অর্থাৎ পানির গভীর জায়গা অথবা কুমের ঘূর্ণায়মান স্থানে মা মাছ ডিম ছাড়ে। চৈত্র মাসে নদীতে মা মাছের দেওয়া ডিম দ্রুত বর্ধনশীল হয়। এজন্য এই ডিমের প্রতি পোনা ব্যবসায়ী ও মাছ চাষীদের আগ্রহ বেশি।
তবে এবার চৈত্র মাসে প্রবল বর্ষণ ও বজ্রসহ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখনও নদীতে মা মাছ ডিম দেয়নি। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে মা মাছ ডিম দিতে পারে। বর্তমানে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় ডিম আহরণকারীরা তাদের দীর্ঘদিনের পেশা অনুযায়ী নৌকা, জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে। হালদা নদীর দুই পাড়ে ডিম থেকে রেনু পোনা ফোটানোর জন্য সরকারিভাবে স্থাপিত হ্যাচারিগুলোতে উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। তাছাড়া সনাতনী পদ্ধতির ডিম পোটানোর মাটির কুয়াগুলোরও সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। ডিম আহরণের প্রধান উপকরণ নৌকাগুলোর মেরামতের কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিম আহরণকারীরা।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউর রহমান হালদা নদী পরিদর্শন করেছেন।
এদিকে বিভিন্ন নদী, খাল ও ছরা থেকে হালদা নদীতে মাছের অবাধ ও নিরাপদ আগমন নিশ্চিত করতে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ ও নৌ পুলিশ সার্বক্ষণিক নজরদারি ও অভিযান জোরদার করেছে। নদী থেকে মাছ চুরি প্রতিরোধে নদীর পাড়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
মাছুয়াঘোনা এলাকার ডিম সংগ্রহকারী মো. নাজিম বলেন, তিনটি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিজের দুটি ছাড়াও একটি নৌকা সাড়ে ছয় হাজার টাকায় ভাড়া করেছেন। নৌকার কাজ শেষ হলে জাল, কাঁচি, নোঙরসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে হবে। খাবারসহ সব মিলিয়ে ডিম সংগ্রহের মৌসুমে কয়েক হাজার টাকা খরচ হবে।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মো. লোকমান (৬৮) বলেন, ছয়টি নৌকা নিয়ে নদীতে থাকবেন। নিজের নৌকা না থাকায় প্রতিটি সাত হাজার টাকা করে মোট ৪২ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন।
গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, আটটি নৌকার মধ্যে চারটি প্রস্তুত, বাকিগুলো মেরামত করছেন। চারটি নৌকার মেরামতেই চল্লিশ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। পুরো মৌসুমে শেয়ারদারসহ সরঞ্জামের খরচ মিলিয়ে প্রায় আশি হাজার টাকা খরচ হবে তার। নদীর পানির রং ও পরিবেশ দেখে তিনি বলেন, এবার লক্ষণ ভালো। নদীর ঘোলা পানি মা মাছের জন্য অনুকূল। এ পানি ডিম দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে। বজ্রসহ বৃষ্টি হলে আগামী পূর্ণিমায় প্রথম জোতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে বলে আশা করছেন।
তবে মাছের আনাগোনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হালদায় এখন পর্যাপ্ত মা মাছ নেই। আগস্টের পর থেকে নদীতে থাকা অধিকাংশ মা মাছ অবৈধ শিকারিদের জালে ধরা পড়েছে। দেশের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জেলেরা বর্শি ও জাল ব্যবহার করে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মা মাছসহ সব ধরনের মাছ নিধন করছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, মাছের আনাগোনা এখন চোখে পড়ার মতো। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আগামী পূর্ণিমার প্রথম জোতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে। হালদার অক্সিজেন ও অন্যান্য পরিবেশ ভালো, লবণাক্ততা নেই বললেই চলে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ডিম সংগ্রহের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। নদীসংলগ্ন সব উপজেলার ইউএনও, মৎস্য কর্মকর্তা ও নৌ পুলিশ হালদার মা মাছ রক্ষায় কাজ করছে। অভিযান জোরদার করা হয়েছে। আশা করছি এবার ভালো ডিম সংগ্রহ হবে।
ইউএন/আরএন