ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না ছাত্র সংসদ কী বা এর কাজ কী। বর্তমানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন অনানুষ্ঠানিক ভাবে ডাকসুর কক্ষ ব্যবহার করছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তোয়াক্কা না করেই বিদ্যুৎ অপচয় করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য (ভিসি) নিয়াজ আহমেদ খান শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন ডাকসু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনারের (ইসি) গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের পছন্দের প্রার্থী প্রস্তাব করেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন, ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সিনেটের অনুমোদন ছাড়া গ্রহণ করা হবে না।
জানা গেছে, পুরো প্রক্রিয়া- অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন গঠন এবং কমিশনার নিয়োগ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। নির্বাচনের সময়সূচি কমিশন গঠনের গতির ওপরই নির্ভর করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্যাম্পাস রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বাস্তবসম্মত নয়। ভিসি নিজেই মনে করেন, ডাকসুর সভাপতির পদে আর উপাচার্য থাকা উচিত নয় বরং গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত কোনো শিক্ষার্থীর এই দায়িত্ব পালন করা উচিত।
ছাত্র নেতারা উল্লেখ করেছেন, শিক্ষার্থীরা এখনো বৃষ্টিতে ভিজে সঠিক আবাসনের দাবিতে এবং যৌন হয়রানির ঘটনার বিচারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। একইসঙ্গে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের গণহত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা যেন কোনো ভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে বিষয়েও তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, এর প্রাথমিক পর্যায় ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসে তাদের কনসার্ন শেয়ার করেছেন এবং প্রশাসন একে একে সেগুলো সমাধান করছে।'
নির্বাচনের আয়তন স্বীকার করে অধ্যাপক বিদিশা বলেন, 'প্রশাসনিক কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা আরও সংগঠিত পর্যায়ে পৌঁছেছি।'
রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগের উত্তর দিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে।'
নির্বাচনের বিলম্বের সম্ভাবনা সম্পর্কে অধ্যাপক বিদিশা স্পষ্ট করে বলেন, 'নির্বাচন তখনই হবে, যখন পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সময়সীমা নির্বাচন কমিশন গঠন এবং কমিশনার নিয়োগের উপর নির্ভর করে, যিনি উপাচার্যের নির্ধারিত পদক্ষেপ অনুসারে এগিয়ে যাবেন।'
স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্বেগের উত্তর দিয়ে তিনি নিশ্চিত করেন, 'প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যাতে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক না হয়।'
পূর্ববর্তী ডাকসু নির্বাচনের সমালোচনা করে অধ্যাপক বিদিশা বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের কাছ থেকেই পরামর্শ চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সাথে আলোচনা ও ডাকসুর স্টেক হোল্ডারদের সাথে মতবিনিময়ের প্রক্রিয়া অনুসরণের গুরুত্ব তুলে ধরেন।'
রাজনীতি বিশ্লেষক এবং ঢাবি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সম্ভাব্য ডাকসু নির্বাচনকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তার মতে, এই নির্বাচন মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্য প্রতিনিধিকে নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, 'যদি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তবে ছাত্র সংগঠনগুলো সত্যিকার অর্থেই শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে।'
ছাত্র রাজনীতিতে এক ধরনের মৌলিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন মাহবুবুর রহমান। যেখানে বর্তমান নেতৃত্ব শিক্ষাবিষয়ক আলোচনা ও নীতি নির্ধারণমূলক বিতর্কে বেশি মনোযোগী।
সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, 'ক্যাম্পাস রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বাস্তবসম্মত নয়, তবে প্রশাসনের উচিত নির্বাচনী কার্যক্রম অরাজনৈতিক ভাবে ও পেশাদার ভাবে পরিচালনা করা।'
তিনি বলেন, 'একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের সম্পর্ক উন্নত করতে পারে। যদি শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে, তাহলে গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে।'
তবে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে এর প্রভাব হতে পারে মারাত্মক। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তাদের উপেক্ষা করা আমাদের সবার ক্ষতির কারণ হবে।'
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমার সংগঠন ডাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ইতোমধ্যে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি এবং হল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মতবিনিময় সভা করেছি।'
তিনি বলেন, 'বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্রে বড় ধরনের সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন।'
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সাহস বলেন, 'প্রতি বছর নিয়মিত ও সুষ্ঠু ভাবে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
প্রশাসনের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আমরা প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখতে পাইনি।'
সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে তিনি একাডেমিক ভবনগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের এবং নেতৃত্বে পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন। তার মতে, ডাকসু সভাপতির পদে উপাচার্যের পরিবর্তে একজন গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত শিক্ষার্থী আসা উচিৎ।
শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নিয়ে সাহস বলেন, 'আরও শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও গঠনমূলক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের পুনরায় সম্পৃক্ত করবে। এবং সতর্ক করেন- ২০১৯ সালের মতো তড়িঘড়ি করে নির্বাচন হলে তা শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার বিরুদ্ধে যাবে।'
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ-মার্কসবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে ছাত্র সংসদ অপরিহার্য। আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছি, আমাদের গঠনতন্ত্র উপস্থাপন করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিনেটে কণ্ঠস্বর থাকবে এবং তারা শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলতে পারবে। আগে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বহু অন্যায় করেছে, কিন্তু তখন কেউ সামনে এসে কথা বলেনি। এখনো কর্তৃত্ববাদী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর একচেটিয়া ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করা অত্যন্ত জরুরি।'
গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি ইউনিটের আহ্বায়ক আবদুল কাদের ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমাদের ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত। তিনি ব্যাখ্যা করেন- আমরা প্রস্তুতিকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখি। যেসব সংগঠন শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছে, শিক্ষার্থীরা তাদেরই সমর্থন করবে। কর্তৃত্ববাদী পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছি, জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছি, গ্রেপ্তারও হয়েছি। এটাই আমাদের প্রস্তুতি। আমরা হলভিত্তিক এবং সেলভিত্তিক ইউনিট গড়ে তুলছি।'
জরুরি প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ডাকসু একটি লাইফলাইন। আজও শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে আবাসনের দাবিতে আন্দোলন করে, যৌন হয়রানির বিচার চায়। আর কর্মচারীরা বিলাসে থাকে। জুলাই অভ্যুত্থানের ত্যাগ প্রমাণ করে ডাকসু কতটা অপরিহার্য।'
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়ে আবদুল কাদের বলেন, 'এই দায়িত্ব প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের।'
২০১৯ সালের নির্বাচন স্মরণ করে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগ হল ও প্রশাসন পর্যায়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছিল। আমরা তখনও প্রতিবাদ করেছি, এখনো যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো।'
তিনি আরও বলেন, 'অভ্যুত্থানের পরও আট মাস ধরে কোনো নির্বাচন হয়নি, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহ ও অসন্তোষ তৈরি করেছে।'
শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে আগ্রহ প্রসঙ্গে আবদুল কাদের বলেন, 'ছাত্র রাজনীতির মানে হলো ‘কে শিক্ষার্থীদের পক্ষে?’, ‘আর কে বিপক্ষে’ তা চিহ্নিত করা। কিন্তু এখনকার নেতৃবৃন্দ অনেক সময় 'লেজুড় সংস্কৃতির' কারণে শিক্ষার্থীদের ভাষায় কথা বলতে ব্যর্থ হচ্ছে।'
ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমাদের সংগঠন ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নির্ধারিত সময়সূচি ঘোষণার আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকবে বলে আশা করছি।'
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'ডাকসু শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দ্রুত আয়োজন করা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, 'একটি সুষ্ঠু ও ভয়হীন নির্বাচনই মূল চাবিকাঠি।'
জুলাই আন্দোলনের পর ক্যাম্পাসে উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন খান।
ছাত্র রাজনীতির অতীতের বিভিন্ন ত্রুটি তিনি স্বীকার করলেও শিক্ষার্থীদের নবউদ্যমে আগ্রহকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। সহিংসতা রোধে তিনি প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা ও সংগঠনগুলোর সদিচ্ছার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর সমর্থনকে তিনি “অত্যন্ত ইতিবাচক ইঙ্গিত” হিসেবে দেখছেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের সংগঠনের প্রস্তুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রয়েছে কি না, যেখানে একটি স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব?'
তিনি বলেন, 'সারাদেশে কার্যকর ছাত্র সংসদ না থাকায় আমরা, অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মিলে, দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। সেই চাপ থেকেই ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আমরা তখনই বলেছিলাম, হলগুলোতে সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি না করে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত না করে এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের বা শিক্ষার স্বার্থে কিছুই আনবে না। বরং এটি দমন-পীড়নের একটি নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠবে। সেটাই ঘটেছে, কারণ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নজিরবিহীন ভাবে কারচুপি করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর সারাদেশে ছাত্র সংসদগুলোকে সক্রিয় করা সত্যিই জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হল প্রশাসন ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে নোটিশ দিয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার দায় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও প্রশাসনের মদদকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা ও অন্যান্য সংগঠন বাধ্য হচ্ছি বিভিন্ন ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সেল্ফ সেন্সরশিপে।'
মুক্তা বাড়ৈ বলেন, 'ডাকসু অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এই সমস্যাগুলো আগে সমাধান করতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাকে শ্রদ্ধা করি। নির্বাচন অবশ্যই দ্রুত আয়োজন করতে হবে, তবে নিরাপত্তা ও সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করে। সহিংসতা, পেশিশক্তি ও দখল প্রতিরোধে প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পরিবেশ পরিষদের নিয়মিত বৈঠক আয়োজন করতে হবে।'
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি সায়েদুল হক নিশান ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেসব সভা ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আয়োজন করেছে, আমরা সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করেছি। আমরা জোটগত রাজনীতি চর্চা করি। এখন ক্যাম্পাসে যে রাজনীতি-বিমুখ পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তা ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কণ্ঠ রোধ করে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ডাকসু নির্বাচন অপরিহার্য। নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে আমাদের জোট যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটাই অনুসরণ করব। তবে, নির্বাচন সবার জন্য সমান ভাবে অংশগ্রহণযোগ্য করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ২৪ ও ৭১ এর গণহত্যার সাথে জড়িতরা যেন নামে বেনামে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তা প্রসাশনকে নিশ্চিত করতে হবে।”
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায় ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়া ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। দেশকে নতুন ভাবে গড়ে তুলতে হলে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনের বিকল্প নেই। এতদিন নির্বাচন হয়নি। শুধুমাত্র এই কারণে বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জানেই না যে ছাত্র সংসদ কী করে। ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহার জন্য দায়ী।'
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের (বদরুদ্দীন উমর) সহ-সভাপতি রূপন্তী দীপা মল্লিক ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমরা, ছাত্র সংগঠনগুলো যে গতিতে প্রস্তুতি নিচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই গতিতে এগোচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের লড়াই শিক্ষার্থীদেরই নেতৃত্বে হতে হবে। আমি মনে করি না কেউ সেটা আটকে রাখতে পারবে।'
ডাকসু অফিসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘জুলাই স্মৃতি গ্যালারি’ স্থাপন করেছে, যেখানে জুলাই অভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনগণের অবদানের দুর্লভ ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে মো. সুজন ডাকসু অফিসে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল-ইসলাম এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে পদে আছেন। তবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন না। কারণ দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা একটি মামলায় চলতি বছরের ০৪ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি আটক অবস্থায় আছেন এবং এখনও তার পরিবর্তে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদও অবসর নিয়েছেন। এখন পুরো অফিস পরিচালনার দায়িত্বে আছেন কেবল সুজন, দু'জন অফিস সহকারী ও একজন ক্লিনার। তবে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত তাদের বেতন দিচ্ছে।
নিরাপত্তা কর্মী সুজন বলেন, 'কোষাধ্যক্ষ না থাকায় আমরা চরম অসুবিধার মধ্যে পড়েছি। কারণ ঋণ, ছুটি মঞ্জুর, বিএফ উত্তোলন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিলসহ অনেক কিছুর জন্য কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।'
সুজন বলেন, 'প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো অনুমতি না থাকলেও, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো প্রয়োজনমতো এই অফিস ব্যবহার করে। তবে টিএসসিভিত্তিক সামাজিক সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদন করতে হয়। গত ১৯ এপ্রিল ছাত্রদল একটি চিঠি দিয়ে কয়েক দিনের জন্য অফিসটি বরাদ্দ নেয়। যদিও বর্তমানে সেখানে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চলছে না।'
তিনি বলেন, 'আমি ব্যক্তিগত ভাবে বৈষম্যের শিকার হই। প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমি এখানে ডিউটি করি। এরপর আমি গেট তালা দেই এবং কারো কাছে চাবি থাকে না। এখানে কখনো কোনো অনৈতিক কার্যকলাপ ঘটেনি। নূর ভাই ও আখতার ভাই নির্বাচিত হওয়ার পর নিয়মিত আসতেন, কিন্তু সংঘর্ষের পর তারা আর আসেননি।'
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাধারণ সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদকের অফিসগুলো অনানুষ্ঠানিক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো ব্যবহার করছে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসহ ছাত্রদল এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। দুটি কক্ষে চারটি ফ্যান অকারণে চলতে দেখা গেছে। যাতে করে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সুজন বলেন, 'এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। কখনো কখনো একসঙ্গে দুই-তিনটি গ্রুপ এখানে বৈঠক করে, তাই রুমগুলো প্রয়োজন হতে পারে। তবুও, বাতি ও ফ্যান বন্ধ করার দায়িত্ব তাদেরই নেওয়া উচিত। সক্রিয় কর্তৃপক্ষ না থাকায় আমরা সবসময়ই একটি কার্যক্রমগত সংকটের হুমকির মধ্যে থাকি।'
ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে একটি টিভি চ্যানেলে ঢাবি প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রচার করে। চ্যানেলটি প্রকাশ করে- ডাকসু নির্বাচনের তারিখ মে মাসের শেষের দিকে ঘোষণা করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুদ্দিন আহমেদ ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'আমি কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বলিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সময়সূচি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন মে মাসের মাঝামাঝি গঠিত হবে। একবার কমিশন গঠিত হলে নির্বাচন মে মাসের শেষের দিকে হতেও পারে। তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশনই। মনোনয়ন দাখিল, যাচাই-বাছাই, প্রত্যাহার ও ভোট গণনার সময়সূচিও তারাই নির্ধারণ করবে। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা ঘোষণা করে, তাহলে সেটা অবৈধ হবে।'
অনুমোদন ছাড়া ডাকসু অফিস রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'অফিসটি খোলা থাকে, তাই আমি দেখেছি ছাত্র সংগঠনগুলো তা ব্যবহার করছে। এ জন্যই আমরা ছাত্রদের অফিসটি আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ডাকসু নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা তাদের বাধা দিতে পারি না। কারণ তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে তারা রুমে বসছে কি না সে বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল না। আমি এটা খতিয়ে দেখবো।'
আগামী জুন মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আয়োজন করলে সর্বাধিক শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হবে- এই মতামত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর। ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করলে সর্বাধিক শান্তিপূর্ণ এবং গ্রহণযোগ্য হবে।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সফল ভাবে আয়োজনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত ‘পরামর্শক কমিটির’ করা এক জরিপে শিক্ষার্থীরা এ মতামত দিয়েছেন।
এমএ