লাউয়ের মাচাংয়ে নেই সবুজের শোভা, গাছ থেকে পড়ছে আমের গুটি ও কাঁঠালের মুচি। প্রায় ৪০ একর ধানের জমির ইটভাটার ধোঁয়ায় পুড়ে গেছে অনেকাংশই। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর ইউনিয়নের বামন সর্দার গ্রামের ৭৮ জন কৃষকের ফসল নষ্ট হয়ে দিশেহারা সবাই।
অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইউএনও, কৃষি কর্মকর্তা ইটভাটা মালিক মমিনুল ইসলামকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বললেও ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বরং কৃষকদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলেছে সেই বিএনপি নেতা ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে। জানা যায়, এমএস ব্রিকসের মালিক মমিনুল ইসলাম রংপুর মহানগরের ২৮ নং ওয়ার্ড বিএনপির আহবায়ক।
সরেজমিনে বামন সর্দার গ্রাম গিয়ে দেখা যায়, ধানের ক্ষেতে আধপাকা ধানের অর্ধেকের রং কালোবর্ণ ধারণ করেছে। আর কয়েকদিন হলেই ধানগাছ কেটে বাড়িতে আনতো কৃষকেরা। তবে সেই আশায় গুড়েবালি। গ্রামের সাথে লাগোয়া এমএস ব্রিকসের বিষাক্ত ধোঁয়ায় হঠাৎ করেই উত্তর পাশের জমিগুলো ঝলসে যায়। ধানগুলোর বেশিরভাগই এখন কেবল চিটা।
সর্দার বামন গ্রামের প্রদ্বীপ বর্মন বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইটভাটা মালিক, ইউএনও, কৃষি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা কয়েক দফা বৈঠক করেন এবং ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে ৭৮ জন কৃষকের ৪১ একর জমির ধান ক্ষতি নির্ধারণ করেন। পরে আবারো বৈঠক করে শতক প্রতি ৫০০ টাকা হারে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করে প্রশাসন। মালিক পক্ষ এ টাকা দিতে সম্মত হন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার এবং রোববার দুই দফা ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেয়নি।
বামন সর্দার গ্রামের প্রদীপ বর্মন বলেন, আমার এক একর ৩০ শতক জমির ধান পুড়েছে। এর মধ্যে এক একর জমির ধান বেশি বেশিরভাগ পুড়ে গেছে। বাকিগুলোর কম পড়েছে। এক একর জমির ধান চাষ করতে আমার খরচ পড়েছে প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এক একর ৩০ শতক জমির ধান যদি ঘরে ঠিকঠাক তুলতে পারতাম তাহলে কম করে হলেও এক লাখ টাকার ধান বিক্রি করতে পারতাম। আমার সমস্ত ধান আজকে চিটা হয়ে গেল। আমি কিভাবে আমার এই সংসার চালাবো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জরিমানা ধরেছে শতক প্রতি ৫০০ টাকা। তবুও কোথাও ৪০০, কোথাও ৩০০ দেয়া হবে। জরিমানায় অর্ধেকও পাচ্ছি না। ইট মালিক আমাদেরকে বুঝিয়ে না দিয়ে নানা টালবাহানা করছে।"
একই গ্রামের শিশির কুমার বলেন, "এর আগেও তিনবার এভাবে জমির ধান ঝলসে গেছে। ইট ভাটার মালিক স্বীকারও করেনি। কোন ক্ষতিপূরণ দেয় নি। প্রতিবার আমাদের সাথে এমন হলে আমরা কার কাছে যাবো। এবারও যখন জমির ধান গাছ ঝলসে গেছে তখন ইটভাটার মালিক বলেছে ঘাস মারা ওষুধ দিয়ে নাকি আমরা আমাদের জমির ফসল নষ্ট করেছি। তিনি বলেছেন পরীক্ষা করে তারপর টাকা দেবেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলল ইটভাটার জন্য জমির এই অবস্থা তখন তিনি বলেন, বেশি ঝামেলা করলে টাকাই দিবো না।"
একই গ্রামের দীননাথ বলেন, আম গাছের আম গুলো ঝরে পড়ছে, কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠালের মুচিও তাই সবগুলো ঝরে পড়েছে। আমরা এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে এমএস ব্রিকস এর ম্যানেজার মনা আমার পায়ের রগ কেটে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। মূলত এম এস ব্রিকসের মালিক মমিনুল ইসলামই তাদের দিয়ে আমাদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন।
এছাড়াও কৃষকের ফসলি জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে মমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। বামন সর্দার গ্রামের শ্রীমতি শান্তি রানী বলেন, ভাটার মোমিন যতদিন ধরে ভাটা দিয়েছে ততদিন ধরে আমাদের জমির ধান পুড়ে যাচ্ছে। আমার সাড়ে পাঁচ দন জমির ধান পুড়ে গেছে। তাছাড়া ইট ভাটার জন্য আমার চার দন জমি নিয়েছে। এক বছর ধরে আমাকে কোন টাকা দেয়নি। জোর করে জমি দখল করে খাচ্ছে। আমরা টাকা নিতে গেলে আমার ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, আমাকে গালাগালি করে। চার দন মাটির টাকা এখনো দিচ্ছে না, ফসলের জমির ধান পুড়ে যাচ্ছে সে যে এসে দেখি সান্ত্বনা দেবে, ক্ষতিপূরণ দেবে তা করেনা। ভিন্ন লোকদের দিয়ে হুমকি দেয়, গালাগালি করে।
এ বিষয়ে এমএস ব্রিকস্ এর মালিক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি টাকার জন্য বারবার ডেকেছি তারা এখন পর্যন্ত টাকা নিতে আসেনি। এটাতো আমার দোষ নয়।’
জমির ধান পুড়ে ছাই হওয়ার কারণে ব্রেন স্ট্রোক করেছেন কৃষক বাবা এমন অভিযোগ তুলে বামন সর্দার গ্রামের সুশান্ত কুমার বর্মন অবজারভার কে জানান, জমির ধান নষ্ট হওয়ার কারণে আমার বাবা ব্রেইন স্ট্রোক করেছে। তাকে নিয়ে রংপুরের ডক্টরস ক্লিনিকে তখন থেকে দৌড়ঝাঁপ করছি। আমার বাবার চিকিৎসার পিছনে এখন অনেক টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রতিবছর মমিনের ইটভাটার কারণে ফসলের ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও মমিনের ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া, প্লাস্টিক বর্জ্য, বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক মেডিকেল বর্জ্য, জুতা পুড়ার কারণে ফসল আম কাঁঠাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমাদের এলাকার যে গর্ভবতী নারীরা আছে তাদের বেশিরভাগ বাচ্চা প্রতিবন্ধী ও ক্যান্সার হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে আমার একটাই অনুরোধ এই ইট ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।"
গ্রামের বেশিরভাগ লোকই জানায়, এমএস ব্রিকস্ ইট ভাটায় বিভিন্ন ধরনের জুতা, মেডিকেল বর্জ্য ও গার্মেন্টসের জুট ব্যবহার করা হয়।
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, টিএমএস ব্রিকস ইটভাটার বিপরীত দিকে রয়েছে একটি তেলের পাম্প। ইটভাটার দু'পাশেই রয়েছে বাড়ি। ইট ভাটার ভিতরে ঢুকে সোজা গেলেই প্রমাণ মিলে গ্রামবাসীর অভিযোগের। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে জুতোর স্তুপ। ভাটার নেই পরিবেশের সনদ কিংবা কোন লাইসেন্স। ইটভাটা মালিকের ভাষ্যে কেবল হাইকোর্টের ব্রিড নিয়ে চলছে ইটভাটাটি।
এম এস ব্রিকসের প্রোপাইটার মমিনুল ইসলাম অবজারভারকে জানান, এলাকার মেম্বার আমার কাছে এসে বলেছে গ্রামের ধানগাছ পুড়ে গেছে। মেম্বার আবার গ্রামের অনেক লোক নিয়ে এখানে এসেছিল, কথা বলে গেছে। এর তিন বছর আগেও একই ঘটনা ঘটেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি অফিসার এসে নির্ধারণ করেছে ৪০ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। কৃষি অফিসার কি বুঝে ৪০ একর দেখাচ্ছে যেখানে আমার ভাটার ধোঁয়া ৩০০ গজের ভেতরে থাকবে। এরপর এটা ভেনিস হয়ে যাবে। আমি যে ক্ষতিপূরণ দিব এটা অতিরঞ্জিত করে আমাকে একটা বিপদে ফেলার জন্য অপপ্রচার করছে। ৯০% জমির কিছুই হয় নাই। আমার হিসেবে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হবে। আমি ২ লাখ টাকা দিব। কিন্তু তারা ৮ লাখ টাকার কথা বলছে।’
তিন বছর আগে কৃষকদের অভিযোগ কোনরকম ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। কিন্তু সেখানে ইটভাটা মালিক বলছেন, ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে।
পাশেই থাকা ইটভাটার এক কর্মচারী জানান, তখন যে ইটভাটার ম্যানেজার ছিল তার হাতে টাকা দেয়া হয়েছিল। সে যদি টাকা না দেয় তাহলে সেটা বসের দোষ নয়।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন বলেন, কৃষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা সেই এলাকায় গিয়েছিলাম এবং আমাদের কৃষি কর্মকর্তা একটা ডাটা তৈরি করেছে। সেখানে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্য আমরা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে একটা জরিমানা নির্ধারণ করেছি। এখন ইটভাটা মালিক দাবি করছে অনেক বেশি জমির পরিমাণ বলা হচ্ছে। তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় আছে।
এসআর