৩০৫.২১ একর জুড়ে বিস্তৃত ও ব্যাপক রূপান্তরের অঙ্গীকার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১০৩ বছরের পুরোনো ক্যাম্পাস তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পুনর্গঠনের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
ডেইলি অবজারভারের বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সরকার থেকে প্রায় ২৮৪১ কোটি টাকার একটি বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছে।” তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ জাবেদ আলম মৃধা নিশ্চিত করেন যে প্রকৃত বরাদ্দের পরিমাণ ২ হাজার ৮৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা (প্রায় ২৮.৪১৮৬ বিলিয়ন টাকা)।
“প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় ১১টি ধাপের মধ্যে আমরা ইতোমধ্যে ৯টি ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন করেছি, এখন কেবল ২টি ধাপ বাকি,” বলেন ড. নিয়াজ আহমদ খান।
তিনি আরও জানান, এই প্রকল্পটি যদি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদন পায়, তবে এটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
“এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আগামী এক দশকের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা দিন-রাত পরিশ্রম করছি এবং সরকারের প্রতিটি স্তরের দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি,” এমনটাই বলেন ঢাবি উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়টি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন” শীর্ষক একটি বিস্তৃত মহাপরিকল্পনার আওতায় তার একাডেমিক, আবাসিক ও প্রশাসনিক কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ার এক রূপান্তরমূলক যাত্রা শুরু করেছে। ৩০৫.২১ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই পরিকল্পনায় রয়েছে পাঁচটি উপকেন্দ্রিক ক্যাম্পাস ও কক্সবাজারে একটি গবেষণা কেন্দ্র, যা স্থাপত্যগত আধুনিকায়ন, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও উন্নত সুবিধাসমূহের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা ও একাডেমিক পরিবেশকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
এক শতাব্দী পুরোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৯৮৯টি স্থাপনা রয়েছে। নতুন মহাপরিকল্পনার আওতায় এদের মধ্যে ৫৮৩টি ভবন ভেঙে ৯২টি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ভবন নির্মাণ করা হবে, যার মধ্যে থাকবে একাডেমিক ভবন, আবাসিক হল ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। এই পুনর্গঠনের কাজ তিনটি প্রধান ধাপে বাস্তবায়িত হবে, যা পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশকৃত সংশোধনের পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল।
আসন্ন অর্থবছরের শুরুতেই অনুমোদন পাওয়া গেলে ২৮৪১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পের প্রথম ধাপ ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে মহাপরিকল্পনায় কিছু পরিমার্জনা ডেইলি অবজারভারকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
একনজরে মাস্টারপ্ল্যানের মানচিত্র
মূল ধারণাটি হলো একটি “আধা-গ্রিড” একাডেমিক নগরী গড়ে তোলা। যেখানে হাঁটার উপযোগী পথ, সবুজ করিডোর এবং শিক্ষার্থীবান্ধব উন্মুক্ত স্থানের মাধ্যমে কলা, বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদসমূহ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। প্রশাসনিক ভবন এবং কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এই একাডেমিক কেন্দ্রবিন্দুর মূল ভিত্তি হবে। আর নতুন আবাসিক হলগুলো এমনভাবে পরিকল্পিত হবে যাতে কোনো শিক্ষার্থী তার শ্রেণিকক্ষ থেকে ১০ মিনিটের বেশি দূরে না থাকে।
পরিবেশগত বিষয়গুলো মহাপরিকল্পনার মধ্যে একীভূত করা হয়েছে। হ্রদের জালিকা, বৃক্ষবেষ্টিত পথ এবং ফোয়ারাগুলো ক্যাম্পাসে শীতল মাইক্রোক্লাইমেট তৈরি করবে। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক জীবন সমৃদ্ধ করতে উন্মুক্ত মাঠ, জিমনেসিয়াম এবং বার্ষিক উৎসব ও আয়োজনের জন্য সংস্কারকৃত স্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় খেলার মাঠকে আধুনিক ক্রীড়া সুবিধাসম্পন্ন একটি স্টেডিয়ামে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনস্মৃতি চিহ্নসমূহ ক্যাম্পাসের নকশায় বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজের আপত্তির কারণে এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।
প্রথম ধাপ: মূল উন্নয়ন কার্যক্রমের সূচনা
প্রথম ধাপে গুরুত্ব দেওয়া হবে মূল অবকাঠামোগত উন্নয়নে। এই ধাপে মোট ৪১টি নতুন ভবন নির্মিত হবে। বর্তমানে একতলা বিশিষ্ট মসজিদুল জামিয়া ভেঙে সেখানে নির্মিত হবে চারতলা বিশিষ্ট একটি মসজিদ কমপ্লেক্স। যার অর্থায়ন সম্ভবত বাংলাদেশ অথবা তুরস্ক সরকার থেকে নেওয়া হবে। এ মসজিদ কমপ্লেক্সে নামাজের স্থানের পাশাপাশি কমিউনিটি সেন্টার, নারী মুসল্লীদের জন্য নামাজের নির্ধারিত স্থানসহ প্যান্ট্রি এবং শিশুদের খেলার স্থানও নির্মাণ করা হবে।
একাডেমিক অবকাঠামোর আওতায় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উত্তর-পশ্চিম অংশ ভেঙে একটি বড়সড় সম্প্রসারণ পরিকল্পনা করা হয়েছে। চার হাজার শিক্ষার্থী ধারণক্ষম আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন আধা-বেজমেন্টসহ ১৩ তলা ভিত্তির উপর একটি ১২ তলা ব্লক এবং ৭ তলা ভিত্তির উপর একটি ৬ তলা ব্লক নির্মাণ করা হবে। ব্লক দুইটির একটি ১২ তলা এবং অপরটি ৬ তলা হবে।
একইভাবে, বর্তমান পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট (আইএসআরটি) ভবনটি ভেঙে আধা-বেজমেন্টসহ একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে, যা মোকাররম হোসেন খন্দকার বিজ্ঞান ভবন ও আইএসআরটি প্রাঙ্গণের মাঝখানে অবস্থিত হবে এবং আইএসআরটি ও ফার্মেসি উভয় বিভাগের কাজে ব্যবহৃত হবে।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি নতুন তিনতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে। চারুকলা অনুষদে বর্তমানের কয়েকটি ভবন, যেমন: কারুশিল্প, ভাস্কর্য, গ্রাফিক্স, সিরামিকস, শিল্পকলার ইতিহাস এবং থিওরিটিক্যাল টিচারস’ লাউঞ্জ ভেঙে সেখানে আধা-বেজমেন্টসহ ছয়তলা ভিত্তির ওপর একটি পাঁচতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বর্তমান একতলা ভবন ভেঙে সেখানে নির্মিত হবে বীর উত্তম শহিদ খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁঞা এমবিএ টাওয়ার নামে ১১ তলা ভিত্তির ওপর একটি আধুনিক ১০ তলা ভবন। এছাড়া, বর্তমান প্রেস বিল্ডিং এবং এর পাশে থাকা টিনশেড নীলক্ষেত পুলিশ আউটপোস্ট ভেঙে একটি নতুন প্রেস ও একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে। এই কমপ্লেক্সে দুটি ব্লক থাকবে। একটি ১২ তলা ভিত্তির ওপর ১১ তলা ভবন এবং অন্যটি ৬ তলা ভিত্তির ওপর ৫ তলা ভবন।
ছাত্রী হল নির্মাণ ও সম্প্রসারণ
নিউ মার্কেটের পেছনে অবস্থিত শাহনেওয়াজ হোস্টেল ভেঙে সেখানে ১৫ তলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। এখানে এক হাজার জন ছাত্রী থাকার সুযোগ পাবে। অতিরিক্ত সম্প্রসারণের মধ্যে রয়েছে শামসুন নাহার হল, যেখানে ৬০০ জন ছাত্রীর জন্য দুইটি নতুন ব্লক তৈরি করা হবে, এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে ৫০০ জন ছাত্রীর জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট একটি নতুন হল নির্মাণ করা হবে। একই ধরনের উন্নয়ন করা হবে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে। হাউজ টিউটর কোয়ার্টার ও সিকদার মনোয়ারা বিল্ডিং ভেঙে সেখানে ৫০০ ছাত্রীর জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট সম্প্রসারিত ভবন নির্মাণ করা হবে। ছাত্রীদের প্রতিটি হলে ২০টি ফ্ল্যাটসহ ১১ তলা বিশিষ্ট হাউজ টিউটর কোয়ার্টার যোগ করা হবে।
ছাত্র হল সম্প্রসারণ
ছাত্রদের জন্য উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। যেখানে টিনশেড সরিয়ে ১,৩০০ ছাত্রের জন্য দুটি নতুন ব্লক নির্মাণ করা হবে। মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ১১ তলা একটি ভবন সংযোজন করা হবে, যেখানে ১,১০০ ছাত্র থাকার ব্যবস্থা থাকবে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে বর্তমানে থাকা আতাউর রহমান খান খাদিম ভবন ও ক্যাফেটেরিয়া ভেঙে তিনটি ব্লক নির্মাণ করা হবে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্লকটি হবে ১৫ তলা। একইভাবে হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল ও ড. কুদরত-ই-খুদা হলে বড় আকারের রূপান্তর ঘটিয়ে যথাক্রমে ১,০০০ ও ৫০০ ছাত্রের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। ছাত্রীদের হলগুলোর মতো প্রতিটি ছাত্রদের হলেও ২০টি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১১ তলা হাউজ টিউটর কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে।
একইভাবে ড. কুদরাত-ই-খুদা হলের বর্তমান বাংলো ভেঙ্গে সেখানে নির্মিত হবে তিনটি ভবন—১০ তলা (ব্লক-১), ৮ তলা (ব্লক-২) ও ৫ তলা (ব্লক-৩)—যা ৫০০ শিক্ষার্থীর জন্য আধুনিক আবাসনের সুযোগ তৈরি করবে। এই প্রকল্পগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সক্ষম করে তুলতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
এই প্রকল্পে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক কোয়ার্টার নির্মাণের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রভোস্ট পাড়ায় সূর্য সেন ও মুহসিন হলের প্রভোস্ট বাংলোগুলোর স্থলে নির্মিত হবে দুইতলা বিশিষ্ট প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর বাংলো। এছাড়া সাউথ ফুলার রোডে ভবন নম্বর ১২ ও ১৩ ভেঙে ১১২টি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট ১৫ তলা একটি শিক্ষক আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর মধ্যে, শিববাড়ি এলাকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আবাসিক কোয়ার্টার ভেঙে নির্মিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মুর্তজা মেডিকেল সেন্টার। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনের স্থলে নির্মিত হবে ১২ তলা বিশিষ্ট একটি বহুবিধ ব্যবহারের ভবন, এবং প্রশাসনিক ভবনটি পুনর্গঠন করে দুটি ব্লকে রূপ দেওয়া হবে। একটি ২০ তলা এবং অন্যটি ৪ তলা।
পাশাপাশি, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য প্রি-ইঞ্জিনিয়ারড জিমনেসিয়ামের নির্মাণকাজও সম্পন্ন করা হবে। এর আওতায় ২,০৪০ বর্গমিটার গ্যালারি, ১০,৯০০ বর্গমিটার খেলার মাঠ, ২,৯০০ বর্গমিটার বাস পার্কিং এবং ৪,০৩২ বর্গমিটার আয়তনের একটি পরিচালক কার্যালয় ও খেলোয়াড়দের জন্য আবাসন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ও জগন্নাথ হল মাঠের পাশে জনসাধারণের জন্য শৌচাগার নির্মাণ করা হবে, এবং ক্যাম্পাসের পানি নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক ২৪ হাজার ৮২০ মিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে নির্ধারিত স্থানে বর্জ্য ফেলার বিনও স্থাপন করা হবে।
অবকাঠামোগত দিক থেকে পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে জলাধারগুলোর (জগন্নাথ হলের পুকুর, শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুর এবং এফএইচ হল ও শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুর) সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন, সড়ক নেটওয়ার্ক ও সার্ভিস লাইন উন্নয়ন এবং বিদ্যমান ইউটিলিটি লাইন মেরামত ও স্থানান্তর।
দ্বিতীয় ধাপ: বিদ্যমান ভবনসমূহের আধুনিকায়ন
১৫১ কোটি টাকার নির্ধারিত বাজেটসহ দ্বিতীয় ধাপে ১৭৩টি বিদ্যমান ভবনের সংস্কার ও আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন করা হবে, যাতে সেগুলো আধুনিক একাডেমিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই ধাপে সকল অনুষদ ও সুবিধাসমূহে পুরোনো ভবনগুলোর নিরাপত্তা, সৌন্দর্য এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ করা হবে।
তৃতীয় ধাপ: সংযুক্তি এবং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
তৃতীয় ধাপে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো একটি আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল নির্মাণ, যা মহসিন হল থেকে শুরু হয়ে নীলক্ষেত হয়ে পালাশী পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। এই টানেল ক্যাম্পাসের যানজট কমাতে এবং শিক্ষার্থীদের চলাচল সহজ করতে সহায়ক হবে।
যদিও প্রথম ধাপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কিছু কাজ এখনও অসম্পূর্ণ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপ সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য জানাতে রাজি নয়।
২৮.৯৩ একরের উপকেন্দ্রিক ক্যাম্পাস
কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসের বাইরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকেন্দ্রিক ক্যাম্পাসগুলোতেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
নিউমার্কেট ক্যাম্পাস (৭.৭১ একর)
এখানে অবস্থিত রয়েছে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ এবং গুরুত্বপূর্ণ নারী আবাসিক হলসমূহ। শাহনেওয়াজ হোস্টেলের পরিবর্তে ছাত্রীদের পরিকল্পিত নতুন হলের নাম পরিবর্তন করে ‘জয় বাংলা হল’ রাখার একটি বিতর্কিত পরিকল্পনা ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের মুখে নাম পরিবর্তনের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।
হাজারিবাগ ক্যাম্পাস (১২.৩৭ একর)
এখানে অবস্থিত রয়েছে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। এই স্থানে নতুন আবাসিক হল নির্মাণ এবং কর্মরত কর্মচারীদের জন্য আধুনিক কোয়ার্টার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
আজিমপুর ক্যাম্পাস (১.৬০ একর)
এটি মূলত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত। এখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আবাসন এবং বাইতুন নূর জামে মসজিদ অবস্থিত।
গ্রিন রোড ক্যাম্পাস (৬.১২ একর)
এখানে দুটি একাডেমিক ভবন, একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রিন সুপারমার্কেট এবং শিক্ষার্থীদের (একটি ছেলেদের জন্য, একটি মেয়েদের জন্য) ও হাউজ টিউটরদের জন্য সম্প্রসারিত আবাসনের মাধ্যমে উন্নয়ন করা হবে।
ধানমন্ডি ক্যাম্পাস (০.১৩ একর)
শুরুতে এটি ব্যাচেলর শিক্ষকদের আবাসনের জন্য পরিকল্পিত ছিল। তবে এখন এই স্থানে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল সম্প্রসারণ করা হবে।
কক্সবাজারের গবেষণা কেন্দ্র (১ একর)
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে সমুদ্রতট সংলগ্ন কবিতা চত্বর এলাকায় অবস্থিত এই কেন্দ্রটি সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান ও পরিবেশগত গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সম্প্রসারণের প্রতীক।
বিবিধ পরিকল্পনা
মহাপরিকল্পনা ছাড়াও বিভিন্ন দান-অনুদানেও ঢাবি নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। পূর্ববর্তী একটি সরকারি উদ্যোগে বাতিল হওয়া ঐতিহাসিক ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) পুনর্নির্মাণের কাজ এখন বিশ্ববিদ্যালয় নিজের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করবে। এদিকে, ঐতিহ্যবাহী কার্জন হল এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম কঠোর প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ প্রোটোকল অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। শীঘ্রই পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলির আন্তঃসরকারি সংস্থা (ওপেক) থেকেও বড় অঙ্কের অনুদান পেতে যাচ্ছে ঢাবি।
একাডেমিক উৎকর্ষ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে এ বিশ্ববিদ্যালয় আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতে অগ্রসর হচ্ছে। জাপানের জাপান সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সি (জেএসটি) এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে প্রায় ১০০ কোটি টাকার দুটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে নেতৃত্ব দেবে ঢাবি। বন্যা সহনশীলতা এবং পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প দুটি জেএসটির সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি রিসার্চ পার্টনারশিপ ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় নির্বাচিত হয়েছে এবং ২০২৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হবে। বাংলাদেশ অংশের গবেষণা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেবেন ঢাবির গবেষকরা।
অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার থেকে কলা ভবন ও লেকচার থিয়েটার ভবনের মাঝের রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ৫৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এই রাস্তার আরসিসি ঢালাইয়ে ব্যয় হবে ২৮.৩৫ লাখ টাকা, এবং ২৩ মে পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। একইসঙ্গে, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সামনের ৬৭৫ ফুট দীর্ঘ আরেকটি রাস্তাও জুন মাসে সংস্কার করা হবে, যার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩১ লাখ টাকা। উভয় প্রকল্পই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এর পাশাপাশি আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি বিস্তৃত ড্রেনেজ উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে সমন্বয়ে পরিচালিত এই উদ্যোগটি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ও একাডেমিক ভবনসমূহকে মৌসুমি জলাবদ্ধতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ঢাবির এই মহাপরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়ন ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন, একাডেমিক উৎকর্ষ এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে কেন্দ্র করে গঠিত এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সর্বোচ্চ উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। প্রকল্পটি এখন একনেকের (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আর এ সময় সরকার, শিক্ষা মহল এবং নাগরিক সমাজের সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন গভীর আগ্রহ নিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করছে। দেশবাসী আশাবাদী যে ১০৩ বছর বয়সী এই প্রতিষ্ঠান নতুন শতাব্দীতে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
আরএন