কক্সবাজারে 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' অভিযানেও অধরা রয়েছে ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার মূল আসামিরা। মাঝে মধ্যে চুনোপুঁটি ও পাতি নেতাদের ধরে বাহবা নিচ্ছে পুলিশ। কিন্তু সম্প্রতি যুবলীগ নেতা মোনাফ সিকদারের ঝটিকা মিছিলের পর নড়েচড়ে বসেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
# ৩৩ মামলায় অধিকাংশ আসামিই অধরা, বেশির ভাগ দুবাই-সৌদি আরবে।
# এখনো উদ্ধার হয়নি কোনো অস্ত্র, ঝটিকা মিছিল নিয়ে পুলিশে উদ্বেগ।
# এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে চিঠি।
# ১৮ মে জাফরকে আনা হচ্ছে চকরিয়ায়।
পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, গত দুই সপ্তাহে পুলিশ বড় পরিসরে অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল আহমেদ বাহাদুরসহ ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে দীর্ঘ ৯ মাস অতিবাহিত হলে এখনো ছাত্র-জনতার উপর প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণকারী কোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনায় ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। অধিকাংশ থানায় ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ অভিযান নিয়েও উদাসীনতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৯ মাসে মাঝারি সারির কিছু নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হলেও প্রশাসনিক তদারকির অভাবে অনেকে গোপনে জামিনে বেরিয়ে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক তথ্য বলছে, কক্সবাজারে ছাত্র-জনতার উপর হামলা, অস্ত্রবাজির অধিকাংশ আসামি দুবাই ও সৌদি আরবে অবস্থান করছে। এজাহারনামীয়সহ বড় মাপের অপরাধীর তথ্য উপস্থাপন করে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। তার আলোকে পুলিশ সুফলও পেয়েছে। তবে সম্প্রতি সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সেকেন্ড ইন কমান্ড দুর্ধর্ষ অপরাধী মিঠাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুস ভুট্টো সৌদি থেকে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে আসামাত্রই পুলিশের জালে ধরা পড়ে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছেন।
৩৩ মামলার অধিকাংশ আসামিই অধরা
জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় কক্সবাজারে ৩৩টি মামলা হয়। এসব মামলার বাদি ছাত্র প্রতিনিধি, বিএনপি ও পুলিশ। এই ৩৩ মামলায় এক হাজার ৯৭৮ জনকে এজাহারনামীয় এবং দুই হাজার ৫১৮ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে মামলার অধিকাংশ আসামিই অধরা।
পুলিশের এক তথ্য বলছে, গেল ৯ মাসে জেলায় প্রায় ৪ শতাধিক এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। আসামিদের জামিনে সহযোগিতায় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা।
জামিনে কয়েকটি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ওকালতনামায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীদের সাক্ষর রয়েছে। তারা আইনী লড়াইও করেছেন। জেলা পুলিশ এ সংক্রান্ত একটি গোপন প্রতিবেদন দিয়েছে।
পুলিশের দাবি, নানা কৌশলে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। জেল হাজতে যেতেই তারা জামিনে চলে আসায় মাঠ পুলিশে গ্রেপ্তার অভিযানে অনেকটা অনীহা দেখা দেয়।
এখনো উদ্ধার হয়নি কোনো অস্ত্র
জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে কক্সবাজার শহরের লালদিঘির পাড়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ব্যাপক অস্ত্রবাজি করেন। অনেকের অস্ত্রবাজি ছবি ভিডিও ভাইরালও হয়েছে। তবে দীর্ঘ ৯ মাস পার হলেও পুলিশ আজ পর্যন্ত কোনো অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি কোনো অস্ত্রবাজকেও ধরতে পারেনি। এমনকি অস্ত্রবাজের তথ্যও সংরক্ষণ নেই। ফলে বিষয়টি ছাত্র-জনতার মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
অধিকাংশ আসামি দুবাই ও সৌদি আরবে
পুলিশের তথ্য ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার উপর হামলা মামলার অধিকাংশ আসামি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই আছেন দুবাই ও সৌদি আরবে। তাদের ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে চিঠি দেয়া হয়েছে।
পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, শুধু বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে চিঠি নয়, নিয়মিত তাদের ব্যবহত মুঠোফোন নাম্বারও ট্রেকিং এ রাখা হয়েছে। যাতে দেশে থাকলে গ্রেপ্তারে সহজ হয়।
আওয়ামী লীগ ধরলে ছাড়তে বিএনপির তদবির
কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন থানায় কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে আসামিদের গ্রেপ্তার করলে, তাদের ছাড়ার জন্য তদবির করেন মাঠ পর্যায়ের কিছু বিএনপির কর্মী। পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, তদবিরকারকদের মধ্যে নেতা গোছের তেমন কেউ নন। উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মীরা বেশীর ভাগ সময় তদবির করে থাকেন।
ঝটিকা মিছিল নিয়ে পুলিশে উদ্বেগ
হঠাৎ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ঝটিকা মিছিল নিয়ে পুলিশের মাঝে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত ০৬ মে কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকত এলাকায় যুবলীগ নেতা মোনাফ সিকদারের নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল নিয়ে রীতিমতো পুলিশ বেকায়দায় পড়েছে।
পুলিশের তথ্য সূত্র বলছে, পুলিশ নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে জেলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করে আসছে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) মো. ইলিয়াস খান ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'যুবলীগের ব্যানারে মিছিলের ৫৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও দেখে পুলিশ তাদের শনাক্তের কাজ করছে। ইতিমধ্যে পুলিশ মিছিলে অংশ নেয়া পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদেরও ধরতে পুলিশ মাঠে কাজ করছে।'
ডিবির কার্যক্রমে ভাটা
কক্সবাজার জেলা পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট গোয়েন্দা পুলিশ। গেল জুলাই মাসে একটি ইয়াবাকান্ডের ঘটনার পর ডিবির কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। আদালত থেকে ইস্যুকৃত মামলা তদন্ত, ভিআইপি ডিউটিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে অংশ নেয়া ছাড়া কোনো কার্যক্রমে তারা নেই।
গত রোববার (১১ মে) কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিমেল হাসান এ তথ্য জানান।
জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, 'ডিবিকে নিয়ে নানা বির্তকের তৈরি হচ্ছে। নতুন এসপি স্যার ডিবিকে পুরোদমে কাজ করাতে আগ্রহী নন।'
১৮ মে আনা হচ্ছে জাফরকে, নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি
রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তারকৃত কক্সবাজার- ১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমকে আগামী ১৮ মে চকরিয়া আদালতে হাজির করার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত ফোর্স চেয়ে পুলিশ সুপার বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে পুলিশ।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৮ মে সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমকে চকরিয়ার আদালতে হাজির করা হবে বলে জানিয়েছেন চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'চকরিয়া ও পেকুয়া থানায় পৃথক দায়েরকৃত চারটি মামলায় তাকে হাজির করা হবে।'
সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়। মহাসমাবেশকে পণ্ড করার জন্য একই দিনে আওয়ামী লীগ পাল্টা সমাবেশ ডাকে। বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যা করার উদ্দেশে পুলিশের সহায়তায় মহাসমাবেশে হামলা চালানো হয়। হামলায় যুবদল নেতা শামীম নিহত হন। এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলম চার দিনের রিমান্ড শেষে কারাঅন্তরীণ রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা কারাগার সূত্র বলছে, এখনো সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলম কেরানিগঞ্জ কারাগারে রয়েছেন। তাকে কক্সবাজার কারাগারে আনার এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
যা বললেন জেলা পুলিশের মুখপাত্র
জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী ডেইলি অবজারভারকে বলেন, 'পুলিশ আগের মতো অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করে না। জেলা পুলিশ নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' অভিযানও অব্যাহত রেখেছে। তাতে সফলতাও রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'গেল দুই সপ্তাহে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুরসহ ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। নাশকতাররোধে জেলা পুলিশ সজাগ আছে।'
এমএ